সান্ত্বনা নেই। শান্তি আছে। যদি সান্ত্বনা চাই, তবে অনেক ব্যাখ্যা, অনেক গল্প, অনেক তত্ত্বের আয়োজন লাগবে। যদি শান্তি চাই, তবে শুধু চাইলেই হবে। জোর করে বললেই হবে, শান্তি চাই।
কিন্তু মনের বড় সমস্যা। সে শান্তিকে চায় সান্ত্বনার মধ্যে দিয়ে। সান্ত্বনা চাই তার আগে। সব কিছুর একটা তার অনুকূলে ব্যাখ্যা চাই। তাই কি হয় বলো? যখন একটার পর একটা দুর্যোগ যেতে লাগল, তখন মনের মধ্যে পাগলের মত সান্ত্বনা খুঁজে বেড়াতে লাগলাম। কত শাস্ত্র, কত দর্শন, কত মহাপুরুষের বাণী। কিন্তু কোনো সান্ত্বনাই ধোপে টিকল না। সব সান্ত্বনারই একটা এক্সপায়ারি ডেট থাকে বুঝলাম। সান্ত্বনা নেই বলে হাজার একটা অভিযোগ করে কোনো লাভ তো নেই।
আসলে সরল সহজ একটা সত্যিকে এড়িয়ে যাচ্ছিলাম, তাই এত কৃত্রিম সান্ত্বনার প্রয়োজন ঘটছিল। যা আমার সঙ্গে ঘটছে, তাকি শুধুই আমার সঙ্গে ঘটছে? আর কারোর সঙ্গে কি ঘটেনি আগে? তা তো নয়। আশাপাশে তাকালেই দেখা যায় আমি একা নই। কিন্তু আমার একটা অজ্ঞ দাবী আছে। যেন আমার একারই একটা বিশেষ ভাগ্যের অধিকার আছে, বিধাতার কাছ থেকে বিশেষ প্রিভিলেজড হওয়ার দাবী আছে….এমন একটা ভাব মনের মধ্যে থেকে যায়। সেই হয় যত নষ্টের মূল।
সান্ত্বনার চাইতে শান্তি অনেক বেশি স্থায়ী। শান্তি মানে একটা সাম্যাবস্থা। তার মধ্যে সত্য আছে। কিন্তু সান্ত্বনা একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিতে সব কিছুকে ব্যাখ্যা করা। তার মধ্যে সত্য নাও থাকতে পারে।
শান্তি আর সান্ত্বনার দ্বন্দ্ব এতটাই গভীর যে একটার সঙ্গে আরেকটা নিবিড়ভাবে মিশে থাকে। সান্ত্বনাকে শান্তি ভেবে গুলাই। শান্তির আসার রাস্তা, সান্ত্বনা পাচ্ছি না বলে, নিজেই অভিমানে আটকে রাখি। ফলে যা যায় তার চাইতে আরো কষ্টের হয় তাকে যেতে না দেওয়ার প্রবল জেদ আমার।
বারবার নিজের কাছে হেরেছি। বারবার নিজের বানানো গল্প, নিজের বানানো কৃত্রিম বিশ্বাস আমাকেই বিদ্রুপ করে গেছে। দুঃসময়ে। সান্ত্বনা নেই। এ কঠিন জগতে সান্ত্বনা বলে কিছু হয় না। যা হয় তা হল শান্তি। সান্ত্বনা শিশুর চুষিকাঠির মত। তাকে সত্যে নির্মাণ করা যায় না, কল্পনায় সৃষ্টি করা যায়।
শান্তির রাস্তা চিরকালই মাটিকে মাটি বলে, জলকে জল বলে। যা সত্য, তাকে অস্বীকার করে, তাকে কোনো বিশেষ রঙে রাঙিয়ে শান্তি পাওয়া যায় না। আর সান্ত্বনা পাওয়ার ইচ্ছা থাকলে তো শান্তি কয়েক হাজার মাইল দূর দিয়ে চলে যায়। তার ছায়াটুকু ভাগ্যে জোটে না।
কিন্তু যা বাস্তব, যা সত্য তাকে স্বীকার করা তো এত সোজা কাজ না। মনের লক্ষ বাসনার রঙ। সে সবকে ধীরে ধীরে তুলে তাকে সত্যের রঙে রাঙানো কি চাট্টিখানি কথা! মন বাস্তব জগতকে তত সত্য বলে জানে না যতটা নিজের চিন্তার জটকে সত্য বলে জানে। নিজের আবেগের ঘূর্ণিকে সত্য বলে জানে। তার হাত থেকে তাকে রক্ষা করে তার মধ্যে শান্তির বীজ বুনতে গেলে তাকে সত্যের দিকে আনতেই হবে।
এই সত্যকে ঈশ্বরের ইচ্ছা, ভাগ্য, বিধাতার বিধান, কর্মফল ইত্যাদি যে তত্ত্বেই সান্ত্বনার রাস্তা খুঁজি না কেন, আসলে সত্যটাকে স্বীকার করে নেওয়াই আমাদের একমাত্র পথ। শান্তির পথ। তাই ধৈর্যর চাইতে বড় কোনো সহায় আমাদের এই ভীষণ দুর্গম রাস্তায় আছে বলে আমরা জানি না। ধৈর্য্যের সঙ্গে সত্যের প্রভুতায় আস্থাই একমাত্র চলার কড়ি। পাথেয়। সান্ত্বনা পেয়ে কি হবে! সে চুষিকাঠির দিন তো গেছে! অবশেষে জিতে যাবে তো সত্যই, সত্যমেব জয়তে। আমি চাই আর না চাই।