আজ দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে বিবেক দেবরায় মহাশয় খুব আক্ষেপ করে লিখেছেন যে কলকাতার প্রধান গ্রন্থাগারেও আধুনিক বইয়ের সংযোজনের হার খুব কম। এবং কি কি আইনে সেটা দণ্ডনীয় অপরাধের মধ্যে পড়ে, তাও লিখেছেন। তা অতবড় মানুষটা যখন বলছেন, তখন অমন একটা আইন নিশ্চয় থাকবে। কিন্তু যে দেশে লাইব্রেরিতে সেই কালিদাসের পর আর কোনো বই সংযোজন হয়নি, সেই দেশের আইনি ব্যবস্থা কোন ধারায় হবে?
আমার ছোটোবেলাটা কাটে রেলকলোনীতে, কাঁচরাপাড়ায়। আমার অত্যন্ত সৌভাগ্য আমাদের কোয়াটার্সের থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে রেলের একটা দুর্দান্ত লাইব্রেরি ছিল। যিনি লাইব্রেরিয়ান ছিলেন, বাবার বন্ধু, বাবার থেকে বয়সে বড়, আমি জেঠু বলে ডাকতাম, 'লাইব্রেরি জেঠু'। বেশ লম্বা চওড়া মানুষ। মাথায় টাক। লাইব্রেরিতে ঢুকলেই দেখতাম একটা টেবল ল্যাম্পের আলোয় কোনো একটা বই মনযোগ দিয়ে পড়ছেন, আমায় একবার আড়চোখে দেখে ক্যাটালগটগুলো বাড়িয়ে দিতেন। উফ্, সে কি উত্তেজনা। অপূর্ব হাতের লেখায়, লেখকের নাম, লাল কালিতে, তার নীচে সার দিয়ে বইয়ের নাম নীলকালিতে, পাশে বইয়ের সংখ্যা। সব গোটা গোটা অক্ষরে। কোনোটাই কাটাকুটি নেই, দুবার বুলানো নেই। এক একটা বইয়ের নাম পড়ি আর বুকটা ধড়াস ধড়াস করে, এক একটা না পড়া বই মানেই এক একটা দেশ আবিষ্কার করা। আমি ক্লাস এইট থেকে এই লাইব্রেরিতে যাতায়াত করছি নিয়মিত। শীর্ষেন্দু, সুনীল, সৈয়দ মুস্তাফা, সমরেশ মজুমদার ইত্যাদির কিশোর গল্প, উপন্যাস থেকে বড়দের লেখায় আসতে শুরু করছি, সমরেশ বসু, নীহারবাবু, নরেন মিত্র, আশাপূর্ণা ইত্যাদিরা আসছেন। একটু একটু ইংরাজি পড়াও শুরু করেছি। অবশ্য তার জন্যে দায়ী বাবার আরেক বন্ধু শ্রদ্ধেয় অলোক স্যার। অসামান্য মানুষ। আমায় ইংরাজি পড়াতেন। একটু ওনার কথা বলে নিই।
অলোক স্যার অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন, মেডিকাল কলেজ পড়ার সুযোগও পেলেন, কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার জন্য পড়া আর হল না। বাড়িতে অনেকগুলো ভাই। তিনি রেলে চাকরিতে ঢুকলেন। নিজের সেই অপূর্ণতা ভুলতে ডুবলেন সাহিত্যে। বিশেষ করে ইংরাজি সাহিত্যে। আমার ক্লাস এইট অবধি ইংরাজিতে দারুণ ভয়। কিন্তু কি করে কি করে সব ভয় কাটিয়ে দিলেন কাকু। বাজারে দোকানে, রাস্তায় যেখানে দেখা হত সেখানেই ভয়েস চেঞ্জ, ট্রান্সলেশান, সমার্থক শব্দ খোঁজা খেলা চলতে শুরু করল। আমাকেও পাগলের মত অনুবাদের নেশা পেয়ে বসল, যা পাই ভুলভাল অনুবাদ করে খাতা দিয়ে আসি। আজ ভাবি কি অত্যাচার সহ্য করতেন আমার জন্য। কিন্তু কোনোদিন বিরক্ত হতে দেখিনি। মানুষটার নিজের স্বপ্ন না পূরণ হতে পারার ক্ষোভ মিলিয়ে গেল ওনার সন্তানদের মধ্যে দিয়ে। প্রত্যেকে অন্যন্ত কৃতি নিজেদের পড়াশোনার জগতে ছিল। আজ জানি না তিনি কোথায় আছেন, তবে এটুকু জানি, আজ যে ভাষাটার জন্য বিশ্ব-সাহিত্যে পাঠকের আসনে বসতে পারি, সে সম্পূর্ণ ওনার জন্য। এ ঋণ শোধ হওয়ার নয়।
তো যেটা বলছিলাম, একটু একটু ইংরাজি পড়া শুরু হয়েছে, প্রথম ধাক্কা খেলাম মনে আছে ডেভিড কপারফিল্ড পড়ে। কেঁদেকেটে একশা। একবারের কথা মনে আছে, টুয়েলভে পড়ি, পেপার থেকে লোলিটার কথা শুনে পড়ার খুব ইচ্ছা। লাইব্রেরিতে গিয়ে যেই না বইটা হাতে নিয়েছি, পিছন থেকে গুরুগম্ভীর স্বর - উঁহু, এখন নয়। গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আমার দিকে লাইব্রেরি জেঠু। উনি আমায় রাধাকৃষ্ণাণ হাতে দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। কল্পনা করুন, কোথায় লোলিতা পড়ার নিষিদ্ধ বাসনা, আর কোথায় শিক্ষার উপরে রাধাকৃষ্ণাণের ইংরাজিতে সংকলিত প্রবন্ধ সমগ্র। তাই পড়লাম। মূল কথা বুঝলাম, রাধাকৃষ্ণানের মতে চরিত্র গঠনই মূল কথা শিক্ষার। বুঝলাম, আমার মধ্যে দুশ্চরিত্র হওয়ার আশু সম্ভবনা দেখেই গোড়ায় কোপ মারতে চেয়েছিলেন।
ক্রমে স্কুল শেষে কলেজ, লাইব্রেরি যাওয়ার সময় কমছে। তবে ইতিমধ্যে উনি ওনার সেন্সর তুলে নিয়েছেন। আমারও স্বাদ ক্রমে ফিকশান থেকে কবিতা আর নন ফিকশানের দিকে যাচ্ছে। লাইব্রেরিটাও যেন আমার সাথে সাথে বড় হচ্ছে। আমার পরম আশ্রয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই গত বছর যখন মুরাকামির 'কাফকা অন দ্য শোর' পড়ছি, যেখানে মূল চরিত্র একটা লাইব্রেরিতে বসবাস করছে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে, আমার কল্পনায় শুধু আমার সেই কাঁচরাপাড়ার রেলের লাইব্রেরি বারবার এসেছে। মন খারাপ হয়েছে। কেন হয়েছে? সে কিন্তু শুধু নস্টালজিক হয়ে পড়া নয়। কারণটা বলি।
আমাদের কাঁচরাপাড়ার পাট চুকল। আমরা হালিশহরে বাড়ি করে এলাম। আমার মনে আছে, আমি যেদিন সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে এসে হালিশহরের নতুন বাড়িতে ঢুকলাম, আগেই সব ফেলে বিকালেই সাইকেল নিয়ে লাইব্রেরির কার্ড করাতে গেলাম। কিন্তু লাইব্রেরি দেখে মাথায় হাত। মনে হল যেন কালিদাসের পর বইয়ের সংযোজন হয়েছে কি? তবু কয়েক মাস পড়লাম। একজন বয়স্ক মানুষ থাকতেন লাইব্রেরিতে। তার সাথে সুন্দর বন্ধুত্ব হল। আজ সেই লাইব্রেরির সাথে আর সম্পর্ক নেই, কিন্তু সেই লাইব্রেরির নতুন জেঠুর সাথে আজও বন্ধুত্বটা অটুট। তারপর সরকারি লাইব্রেরিতে গেলাম, আগের লাইব্রেরি থেকে কিছুটা ভালো, তবু খুব আপডেটেড বলতে যা বোঝায় তা বিন্দুমাত্র নয়। সেখানে চাকরির জন্য পড়া চলে, খবরের কাগজ পড়া চলে।
তবে বই পাই কই? শুরু হল মাঝে মাঝে কলেজস্ট্রীট যাওয়া। কিন্তু তাও বা সময় হয়ে ওঠে কই? তারপর সে অভাব পূরণ করল যখন অনলাইন শপিং শুরু হল। ক্রমে বইয়ের জন্য হাহাকার ঘুচল। তারপর শুরু হল মোবাইলে, কম্পিউটারে, ট্যাবে, কিণ্ডলে বই পড়ার চল। কিন্তু তবু সেই নিঃশব্দ অক্ষরগুলো, একছাদের তলায় সার দিয়ে কালের প্রবাহ পেরিয়ে আমার হাতের স্পর্শের অপেক্ষায়...আমি যাব...খুঁজে বার করব...সময়ের মধ্যে সময়কে হারিয়ে, নিজের ব্যক্তি আমির পাঁচিল ডিঙিয়ে অন্যের আঙিনায় ঢুকে বসব, সে সুখ আর নেই। আজ সব কিছু বড় আমি-তুমির মধ্যে। লাইব্রেরি - যেমন সমুদ্রের তীরে এসে দাঁড়ানো, সেরকম অনুভূতি কই?
সৌরভ ভট্টাচার্য
16 November 2018