Skip to main content

 

ঝড় থেমে গেছে। বাতাসে ভেসে আসছে রবীন্দ্রসংগীতের সুর। দূরে মাইকে বাজছে কোথাও। রবিবারের সকাল। এলোমেলো বাতাসে গাছগুলোর নড়েচড়ে ওঠার আওয়াজ।
       সুরে একটা যন্ত্রণা থাকে। দূরের যন্ত্রণা। মনের মধ্যে দূর একটা থাকেই। স্মৃতি যাকে আগলে রেখেছে, সে যে বাস্তবে কোথাও নেই, কিন্তু সে যেন দূরে কোথাও আছে, এ বিশ্বাসে একটা যন্ত্রণা যেমন আছে, তেমন একটা সুখও আছে। যে ছেড়ে গেল, সে যেন শুধু আমার নৈকট্যই ছেড়ে গেল, সে যেন শূন্য হয়ে গেল না। কারণ আমি তাকে ভালোবেসেছিলাম। আমি যাকে ভালোবেসেছিলাম সে শূন্য হয়ে যায় কি করে? সে দূরের হয়ে যায়। দূরের ওপর এমন বিশ্বাস আমাদের, এমনই আবদার। সে দূরত্বে আমরা কোনোদিন পৌঁছাব না, পৃথিবীর কোনো যানবাহন সেখানে যায় না, তবু সেই দূরত্বেই আমার ভালোবাসার স্মৃতির নিত্য অবগাহন।
       ছেড়ে আসা দিনগুলোতে যে ভালোবাসার মুহূর্তরা, মানুষেরা ছিল, তারা আজ কই? কিন্তু সেদিন যে গান বেজেছিল, আজও সেই গান বাজছে। সেদিন আমার ভালোবাসার মানুষটা যে মাটিতে, যে আকাশটার নীচে দাঁড়িয়েছিল, সেই আকাশ, সেই মাটি এই তো আমায় ঘিরে আজও রয়ে গেছে। শুধু সে নেই, সে গেল কোথায়? সে দূরে আছে। এই যে গানটা বাজছে, গানটা রবীন্দ্রনাথের। যে নির্জনে তিনি গানটা লিখেছিলেন, সুর দিয়েছিলেন, আমায় ঘিরে আজ সে নির্জনতা। নির্জনতা কি শুধুই জনশূন্যতা? তা তো নয়, নির্জনতা মানে অন্যের উপস্থিতির বোধশূন্যতা। আজ এই মুহূর্তে আমার চারপাশে যারা, তাদের দিকে আমার বোধের মুখ ফিরে নয়। আজ আমি উদাসীন। আমার সমস্ত কাজ-কর্তব্য-দায় ভারশূন্য। কারণ আজ দূরের মানুষেরা এই ঝোড়ো হাওয়ায়, ওই গানের সুরে আমার মনে ভিড় করে এসেছে। খানিকবাদেই সব মিলিয়ে যাবে জানি, তখন বর্তমান জগতের নানা কর্তব্য, হাসি-রাগ-অভিমান-ঈর্ষা-ক্ষোভ আবার আমার মনের অববাহিকায় প্রবাহিত হবে, কিন্তু এখন না। এখন আমি স্মৃতির গভীরে। সেই দূরের পথে যে দূরে কোনোদিন পৌঁছাতে পারব না, কিন্তু যেতে চাইব প্রতিদিন।
       তারপর হঠাৎ সুর কেটে যাবে। পথের দিশা হারাব। দূরের মানুষেরা বিস্মৃতির আড়ালে আবার ফিরে যাবে। আমায় ঘিরে এক বিষণ্ণতা। বিচ্ছিন্ন ভালোবাসার বিষণ্ণতা। বিচ্ছেদের যন্ত্রণার কোনো সংলাপ নেই। মানুষ বলে মানুষ নাকি সবলা? সত্যিই কি তাই? সব কিছুর ভাষা আছে? নেই তো। মানুষ সবলা ততটুকুই যতটুকু সে পাড়ের দিকে থাকে। যত সে তার ভেলা নিয়ে মাঝসমুদ্রের দিকে যায় তার ভাষা যায় বুঝি সাথে? যায় না তো। তাই পাড়ের থেকে যত মানুষ তারা একসাথে পাড়ি দেয় মাঝসমুদ্রে তত মানুষ তার সাথে যায় কি? যায় না। তারা ফিরে আসে পাড়ের দিকে। ভাষার ভার ছেড়ে যাওয়া বুকে তখন নিঃশব্দ ঢেউ ওঠা পড়ার শব্দ। দূরের আকাশে চিলের পাখা ঝাপটানোর শব্দ। সে শব্দের ভাষা নেই, সুর আছে। সে সুরে মিশে বেদনা। অসীমের বেদনা আমার এই সসীম সত্তায় আত্মপ্রকাশের। ওই দিগন্তের রেখা আরো দূরে দূরে সরে যাচ্ছে। মন তখন আকাশের অতিথি, অসীমের দোসর। তাকে ভাষা ছোঁয় কি করে? যতো বাচা নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ – যেখান থেকে মন ফিরে আসে বাক্যের সাথে তাকে না পেয়ে। কাকে না পেয়ে? তার কোনো সংজ্ঞা নেই। তার কোনো রূপ নেই। তার অনস্তিত্বও নেই, তার অস্তিত্বও নেই। সে ক্ষুদ্র নয়, সে হিংসা নয়, সে ক্ষোভ নয়, সে অপ্রেম নয়, সে অপ্রকাশ নয়। যেন তার প্রকাশের মধ্যেই সব কিছুর প্রকাশ। তার অস্তিত্বের মধ্যেই যেন সবের অস্তিত্ব। এমন অস্তিত্বকে বলা হল ভূমা – অর্থাৎ সব। এই ‘সব’ কথাটা আমার লোভের নয়, আমার হাত পাতার নয়। আমার দেওয়ার, আমার নিজেকে শূন্য করার, আমার হাত উপুড় করে দেওয়ার। সবকে দেওয়ার আমার ক্ষুদ্র যা কিছু সঞ্চয়। তাকি ভাষায় হয়? হয় না তো। তাই ভাষা আগেই ছেড়ে গেছে সে তীরে আমায়, আমার সেখানে নীরবে যাওয়ার। সেখানে দূরত্বের যন্ত্রণা নেই, আবার নৈকট্যের আবদ্ধীকরণও নেই, সেখানে মুক্তি, সেখানে ছুটি, সেখানে আনন্দ, সেখানে পূর্ণতা।
       সেখানে কি পৌঁছায় তবে? সেখান পৌঁছায় একমাত্র সুর। সে সুরকে ভুলে থাকা যায় নিত্য জীবনে, সরিয়ে রাখা যায়, শূন্য করা যায় না। কারণ খাদ না মিশলে গয়না হয় না। কিন্তু সোনার যখন গয়না হতে ইচ্ছা করে না? কারোর শরীরের সাথে লিপ্ত হয়ে থাকতে ইচ্ছা করে না? সে যখন কিচ্ছু হতে চায় না? তখনই সে নিজে যা তাই হয়ে যায়। সে সুর তার আঙিনায় তখন, গৃহস্থের আঙিনায় বাউল যেন। সে সুরকে ফিরে শোনে শোনে, আনমনা হয়। যেন তার মানে সে বোঝে।
       আমাদের সব কিছু নিয়ে দৌড়-ঝাঁপ, হয়ে ওঠা, হতে চাওয়া – ইত্যাদির ভীষণ ছোটাছুটি যখন, তখন আমাদের জোয়ারের সময়। সাগর থেকে জল ঢুকছে নদীতে। কিন্তু সে তো আধখানা সত্য। সে জলকে ফিরিয়েও দিতে হবে যে ভাঁটায়, সাগরে, তবেই পুরো সত্যটা হবে। এই জোয়ার ভাঁটার মাঝখানে যে সুরটা বেজে চলে তাকে ভাষা ধরতে পারে না, আভাস দিয়েই ফুরিয়ে যায়। আমরাও ভাষা হারিয়ে ভাসি। যা কিছু মলিনতা তার জন্যে কাঁদি। সাগরের দিকে হাত বাড়াই। হাত বাড়াতে বাড়াতে বুঝি হাতটা মিলিয়ে গেল, কারণ আমরা চিরকালই সেই সাগরে, সেই অনাদিকালের থেকে ভেসে অস্তিত্ব আর অনস্তিত্বের মধ্যেখানের সুরের সাগরে। যাকে কেউ বাঁধতে পারেনি আজ অবধি। নিজেকে নানা তত্ত্বে বেঁধে নিজেকে ঠকিয়েছে মানুষ, যতদিন না সুর এসে মুক্তি দিয়ে বলেছে – চলো এবার। সেদিন তার নিজের এতদিনের সঞ্চয় অর্থহীন লাগে, সে বলে শুধু আমায় নিয়ে, আমায় মিলিয়ে আমার থেকে আমায় মুক্তি দাও, আমায় তোমার মধ্যে লীন করো, যে ‘তোমার’ শব্দটার সংজ্ঞাও সে জানে না। সে অজানাই সেদিন তার পরম জানা, পরম মুক্তি। কারণ সে তাকে জানে না, কিন্তু সুরের মাধ্যমে আত্মীয় বলে বোধ করে। বোধ কি জানা না সংজ্ঞা?