সৌরভ ভট্টাচার্য
22 April 2019
মাননীয় ধর্মাবতার,
আমার জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করুন। আগামী প্রজন্মের মানুষদের কানেও যেন এই জবানবন্দি পৌঁছায় তার ব্যবস্থা আপনি করুন। কারণ আপনার ন্যায়বিচারের শেষে আপনি যে শাস্তি আমার জন্য বরাদ্দ করবেন তাতে আমি জীবিত থাকার যোগ্যতা হারালেও হারাতে পারি। ধর্মাবতার, আমার একান্ত অনুরোধ আমার এ জবানবন্দি যেন পৌঁছায় আগামী প্রজন্মের মানুষের কাছে।
আমি বলছি। কিন্তু বলতে গিয়ে বুঝতে পারছি বলাটা ততটা সহজ নয় যতটা ভেবেছিলাম। এক কথায় বলা যায় না। একটা শব্দ, ‘ক্ষোভ’ - বললে মনে হয় যেন সবটা বলে ফেললাম, কিন্তু আসলে কি বললাম? কিচ্ছু বললাম না। আমার মত অনেক নির্বোধ নরনারীতে পূর্ণ এ সমাজ, যারা জানে না কি সাংঘাতিক এক মানসিক বিকারে আক্রান্ত তারা। প্রতিদিন তিলে তিলে নিজের আত্মাকে ক্ষয় করে চলেছে, তবু হায়, তারা বুঝতে পারছে না তারা কি নরকের মধ্যে নিজেকে ধাক্কা মেরে ফেলে, ওঠার সিঁড়ি পুড়িয়ে ফেলে কি যন্ত্রণায়, অসহায়তায় দিন কাটাচ্ছে। এ অসহায়তা কল্পিত, স্ব-আরোপিত ধর্মাবতার। তবু মানুষ এর থেকে বেরোতে পারে না, এমন মূঢ় আমাদের 'মন' নামক অদ্ভুত জন্তুটা ধর্মাবতার। আমার বলতে বলতে কান্না ঠেলে আসছে, গলা বুজে আসছে, আমার বিগত দিনগুলোর কথা মনে করে নিজেকে নিয়ে জঙ্গলে চলে যেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু এর কোনোটাই আমি করিনি ধর্মাবতার।
ক্ষোভের একটা সহধর্মিণী আছে ধর্মাবতার – ঈর্ষা। ওর যা আছে, আমার কেন তা নেই – এ এক অদ্ভুত রোগ। আমি যেন শতাব্দীর পর শতাব্দী এই রোগে আক্রান্ত ছিলাম। আমার যা আছে তাকে রক্ষা করার জন্য লড়াই কোনোদিন করিনি, শুধু বিষের তুণে বিষাক্ত বাণ ভরেছি – ওদের কেন আছে ভেবে ভেবে। আমার রাত-দিন একটুও শান্তি ছিল না ধর্মাবতার। আমার ক্ষমতার পরিমাপ, যোগ্যতার পরিমাপ, শ্রমের পরিমাপ কোনোদিন করিনি। ওদের ধরেই নিয়েছি অসীম। ঈশ্বরের মত। মনে হয়েছে ঈশ্বরের করুণা যদি অসীম হয়ে থাকে, আর তাঁর সেই অসীম ক্ষমতার প্রতি বিশ্বাস যদি খাঁটি হয়ে থাকে তবে কেন আমার ক্ষমতা, যোগ্যতা ইত্যাদি সসীম হবে আমার শরীরটার মত, আমার রূপের মত। আমি নিজেকে বারবার বিচারের দোরগোড়ায় আনার থেকে রুখে দাঁড়িয়েছি। ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলেছি, আমি তাঁর সন্তান, আমি অসীম কিছু প্রাপ্তির সম্ভাবনা রাখি, কেন তবে এ অবিচার আমার প্রতি?
হ্যাঁ ধর্মাবতার, আপনি ঠিকই অনুভব করছেন। আমি ক্রমশ মানুষ থেকে ঈশ্বরের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে শুরু করলাম। আমার মনে হতে লাগল তিনি বড্ড একপেশে। তাঁর বিচার বলে কিছু নেই, তিনি নপুংসক। হ্যাঁ ধর্মাবতার, আমার ঠিক এই কথাগুলোই মনে হয়েছিল। আমি যদি আজ থেকে পাঁচশো বছর আগে জন্মাতাম হয়তো এই কথাটার জন্য এখনি আপনি আমায় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতেন। কিন্তু আমি জানি আজ আপনি তা দেবেন না। এ যুগ আলোকিত যুক্তির যুগ। আপনি ধৈর্য ধরে আমার কথা শুনবেন। জুরিদের সাথে আলোচনা করে আমার শাস্তির বিধান দেবেন। যদি আপনার হৃদয়ে ঈশ্বরের প্রতি প্রেম থাকে, তবে আপনার হৃদয়ে নিশ্চয় এখন ক্রোধের আর ঘৃণার আগুন জ্বলছে আমার প্রতি। কিন্তু আমি জানি তবু আপনি চুপ থাকবেন, কারণ আপনার পদের সম্মানের প্রতি আপনি দায়বদ্ধ। আমি করতালি দিচ্ছি আপনার এই মহানুভবতায় ধর্মাবতার।
আমি ক্রমে নাস্তিক হয়ে উঠলাম। আমি বুঝলাম, ঈশ্বর একটা বুজরুকি। ওতে আমল দিয়ে জীবন নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। আমি যেই ঈশ্বরকে কবর দিলাম বা সৎকার করলাম, ধর্মাবতার, অমনি আমার হৃদয়ের মধ্যে থেকে ধর্মের শেখানো সমস্ত শুভ চিন্তাগুলো উধাও হয়ে গেল। আমি বুঝলাম, আমি ভালো হয়েছিলাম ভয়ে। ধর্মের সুক্ষ্ম ভয়ে, নিজের অবমাননার ভয়ে, ঈশ্বরের দৃষ্টির সামনে অবমাননার ভয়ে। আসলে মানুষের আজন্ম একটা বাধ্য হয়ে চলার অভ্যাস গড়ে দেওয়া হয় ছোটো থেকে। এখন সেই অভ্যাসটা এমনই পাকাপোক্ত যে তাকে নিয়ে আর দ্বিধা হয় না মানুষের। ছোটোবেলায় বাবা-মা, পরে শিক্ষক, হাস্পাতাল-অফিস-কাছারি ইত্যাদির হাজার নিয়মকানুন, তারপর দেশের সংবিধান। এত কিছুর কাছে বাধ্য হয়ে চলতে চলতে তার বিশ্বাস হয়ে যায় যে, যে বাধ্য হয়ে চলে সেই ভালো। সেই সৎ। সে পুরস্কার পাবে। কিসের পুরস্কার সে ধারণাটা তার কাছে স্পষ্ট নয়, কিন্তু সে জানে একটা পুরস্কার সে পাবে। যত দিন যায় তার লোভটা তত বাড়ে, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত পুরস্কারটা তার কপালে এসে জোটে না। ইতিমধ্যে যে ক'টা কিছু পেয়েছে তাকে পুরস্কার হিসাবে ভুল করেছে বুঝতে পেরেছে, কারণ যা পেয়েছে তার সাথে তার যতটা মাথা নীচু হয়েছে বাধ্যতায় সে হিসাব মেলেনি। আমি এখানে একটা কথা বলে নেব ধর্মাবতার। মানুষ স্বভাবতই লোভী। তাই তার হিসাবে সে কোনোদিন সন্তুষ্ট হবে না। যা পাবে তাই তার কাছে তুচ্ছ হবে। এ অবধারিত। এবার তার মধ্যে জন্মাবে ক্ষোভ। ও! একটা কথা তো বলতেই ভুলে গেছি। এই বাধ্য হয়ে চলার শ্রেণীকক্ষে কখন যে ঈশ্বর এসে অলক্ষ্যে দাঁড়ায় সে জানতেও পারেনা। সে কেবল বুঝতে পারে যে তাকে ঈশ্বরের বাধ্য হয়েও চলতে হবে। এবার তার সামনে একটা অলৌকিক, অযৌক্তিক পুরস্কারের লোভ এসে দাঁড়ায়। কারণ, ঈশ্বর স্বয়ং অলৌকিক, অযৌক্তিক। তার ক্ষোভের মাত্রা আরো বাড়তে থাকে, সাথে ঈর্ষা। কিন্তু এর থেকে বেরোবার কোনো পথ সে জানে না, কারণ নীরবে নিজের ঈর্ষা আর ক্ষোভ নিয়ে চলাই তার ভবিতব্য সে বুঝে নিয়েছে। কারণ মাত্র কয়েক প্রজন্মের মানুষের জীবনে বিপ্লব দেখার সুযোগ হয়ে থাকে। বাকি শতাব্দীর পর শতাব্দী সে মুখ গুঁজেই বাঁচা-মরা অভ্যাস করে ধর্মাবতার।
আমি জানি আপনি কি ভাবছেন। আপনি ভাবছেন আমি কেন ঈর্ষা জারিত ক্ষোভকে বিপ্লবের তুষের সাথে তুলনা করছি, তাই তো? তুলনা করছি না, একটা আরেকটার থেকে বাঁচার উপায়। যেমন বসন্তের ঝরাপাতা কালবৈশাখীর ঝাপটে উড়ে চলে যায়, এ সেরকম একটা কিছু ভাবতে পারেন ধর্মাবতার। তেমন মানুষের ক্ষুব্ধ চিত্ত বিপ্লবের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে শুদ্ধ হয়েছে, মানুষ আত্মত্যাগী হয়ে নিজের প্রাপ্য অধিকার বুঝে নিয়েছে এমন কাল তো এসেছে মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে ধর্মাবতার। আসেনি?
কিন্তু হায়! আমার অন্ধকারাচ্ছন্ন বিষাক্ত ক্ষুব্ধ জীবন। আমি কোনো কালবৈশাখী দেখিনি ধর্মাবতার আমার জীবনে। কয়েকটা মিথ্যা বসন্ত এসেছে। আমি চিরটাকাল ঈর্ষাসিক্ত ক্ষোভেই কাটিয়ে দিয়েছি। সারারাত জেগে ছুরিতে ধার দিয়েছি অথচ প্রতিবেশীর কানে যেন না পৌঁছায় তাই কোনো মধুর সংগীতকে ভাড়া দিয়েছি জিভে। চোখের মণির মধ্যে ঈর্ষাকে ঢেকে কপট তৃপ্তির পর্দা টাঙিয়েছি। কিন্তু প্রতিদিন রাত জেগে জেগে অপেক্ষা করেছি প্রতিবেশীর মৃত্যুর খবরের, বন্ধুর আত্মহত্যার খবরের, কোনো সোনা ভর্তি জাহাজডুবির যে সোনার আমার বাড়িতে আসার কথা ছিল না। আমি অপেক্ষা করেছি আনন্দে বুক চাপড়ে কাঁদার শোক দেখানোর জন্য, যাতে করে আমি সবাইকে দেখাতে পারি যে আমি ভীষণ মানবদরদী, সন্তুষ্ট, প্রফুল্ল একজন মানুষ। আদর্শ মানুষ। কিন্তু সেও হয় না। আমি একটা মিথ্যা কথা বলেছি ধর্মাবতার। আমি ছুরিতে শুধু রাতে না দিনেও ধার দিতাম, আমার ঘরের গোপন কক্ষে, যে ঘরটাকে আমার পাড়া-প্রতিবেশীরা ঠাকুরঘর বলে জানত। আমার পূজোর মন্ত্রোচ্চারণে, ঘন্টার আওয়াজে, আমার শুদ্ধ পোশাকের আড়ালে আমি যে একটা আস্ত শয়তান হয়ে উঠছিলাম কেউ জানতেও পারত না ধর্মাবতার। আমি ক্রমশ ক্রমশ একজন নরখাদক হয়ে উঠছিলাম। সবাই আমার শত্রু। কার অমঙ্গলের আকাঙ্ক্ষা আমি না করতাম ধর্মাবতার! ক্ষোভ, হ্যাঁ হ্যাঁ শুধুমাত্র এই একটা শব্দ আমার মাথার প্রতিটা কোষকে নষ্ট করে দিচ্ছিল ধর্মাবতার! সেই নষ্ট কোষের মধ্যে রক্ত শুষে খাচ্ছিল ঈর্ষা। তাতে ছত্রাকের মত জন্মালো হিংসা। আমি একজনকেও হত্যা না করে লক্ষ মানুষের হত্যার ভার নীরবে মাথা নীচু করে বয়ে নিয়ে চলতে শুরু করলাম ধর্মাবতার! আর কেউ না জানুক, আমি তো জানতাম প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে চলেছি আমি নিঃশব্দে; কেউ না জানুক, আমি, ধর্মাবতার, আমি তো জানতাম!
একদিন এক ধর্মসভায়, প্রার্থনারত অবস্থায় আমি বোমের একটা কুঁচিতে কয়েকশো মানুষের সাথে মারা গেলাম। আমার শরীরের রক্ত গিয়ে মিশল আমার আরাধ্য দেবতার শরীরে। সেই প্রথম আমি ঈশ্বরের মুখোমুখি হলাম। আমি আর্তনাদ করার সময়টুকুও পাইনি ধর্মাবতার। কিন্তু দেখলাম আমার ভিতর থেকে একটা সাদা পাপড়ির মত আলো মিলিয়ে গেল। সে পাপড়িটা কি উজ্জ্বল, কি শুভ্রতা তার! আমি বুঝলাম, সেই ছিল আমার সত্যকারের সুখ যা একান্ত আমার হতে পারত যদি না আমি ক্ষোভের বিষে পড়তাম। দেখতে দেখতে আমার ভিতর থেকে কোটি কোটি পোকা বেরিয়ে পড়তে লাগল। আমার ক্ষোভের বিষ, সারা আকাশ ছেয়ে ফেলল কালো মেঘে। আমি অন্ধকারে চোখ বন্ধ করলাম। তারপর চোখ খুলে দেখি আমি আপনার সামনে দাঁড়িয়ে ধর্মাবতার। কিন্তু এই প্রথম আমার প্রাণে কোনো অশান্তি নেই। আমি বুঝেছি যে সাদা পালক আমি দেখেছিলাম সেও মিথ্যা, আমার সুখের কল্পনা মাত্র। কেবল আপনিই সত্য ধর্মাবতার – মহাকাল, আমার বিচার করুন।