ভারতীয় সন্তানদের মধ্যে কি অপরাধবোধ বেশি হয়? সন্তান হিসাবে? ভারতীয় বাবা মায়ের আশা পূরণ করতে পারা কি অন্যান্য দেশের চাইতে বেশি কঠিন? আমি সুস্থ সম্পর্কের কথা বলছি না। বলছি টক্সিক সম্পর্কের কথা।
আমরা নানা টক্সিক সম্পর্ক আলোচনা করি। সবটাই মূলত পুরুষ-নারীর সম্পর্ক ঘিরেই আলোচনাটা গড়ায়। কিন্তু টক্সিক প্যারেন্ট শব্দটার সঙ্গে আমরা কতটা পরিচিত?
আমার মনে হয় ভারতের সামাজিক পরিকাঠামোর আড়ালে, ভারতীয় পারিবারিক মূল্যবোধের আড়ালে এই টক্সিক পিতামাতারা অনায়াসে নিজেদের টক্সিসিটিটাকে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেন।
টক্সিক প্যারেন্টের কয়েকটা লক্ষণ যা মনোবিদেরা করেছেন। তা মোটামুটি হল।
১) ভীষণরকম ম্যানিপুলেটিভ হবেন তারা। সন্তানের সব কিছুকেই নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইবেন। আপাতভাবে মনে হবে ভালোর জন্য, কিন্তু সেটা আসলে তাদের অস্বাস্থ্যকর স্বভাব।
২) সন্তানের লাইফস্টাইল, পছন্দ অপছন্দ নিয়ে ভীষণ ভোকাল হবেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সমর্থন জানাবেন না।
৩) সন্তানকে সর্বক্ষণ একটা অপরাধবোধের মধ্যে রাখতে চাইবেন, নিজের দাবী না মিটলেই। নানা ধরণের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল তো আছেই সঙ্গে সঙ্গে। আর টক্সিক পিতামাতার দাবীরও অন্ত নেই।
মোটামুটি এগুলো কয়েকটা লক্ষণ। যেটা হবে সেটা হল এই যে, এই ধরণের পিতামাতার সান্নিধ্য কখনওই সুখকর নয়। যেহেতু তারা ভীষণ জাজমেন্টাল, এবং স্বাভাবিকভাবেই ভীষণ ডিজরেসপেক্টফুল, ফলত এদের সঙ্গ বেশিক্ষণের হলেই সন্তানের মধ্যে একটা সব কিছু নিয়ে কনফিউশজড দশা চলে। নিজেকে নিয়ে ভীষণ আত্মবিশ্বাসের অভাব। কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে এতদিক থেকে ভাবতে বসে যে আদতে কোনো কাজই নিজের সিদ্ধান্ত, পছন্দ অনুযায়ী হয়ে ওঠে না। এসব সন্তানদের মূল ধর্মই হল বাবামা-কে তুষ্ট করা। জীবনে নিজের মেরুদণ্ডের জোর বাঁকতে বাঁকতে এমন জায়গায় এসে ঠেকেছে যে মেরুদণ্ড কোনোদিন যে ছিল কিনা সেটাই প্রশ্নের সামনে এসে দাঁড়ায়।
মনোবিজ্ঞানীরা কিছু কিছু টিপস দেন এই সব সন্তানদের নিজের নিজত্ব বাঁচিয়ে বাঁচার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য। কারণ কখনওই ঠিকটাকে বুঝে চলার জন্য তত দেরি হয়ে যায় না। টিপসগুলো হল ---
১) বাবা-মাকে খুশী করাই জীবনের উদ্দেশ্য নয়। সব সিদ্ধান্তের নিয়ামক হতে পারে না। অবশ্যই বাবা মায়ের উপর শ্রদ্ধা সম্মান থাকবে, তবে সেটা যেন পৌরাণিক গল্পের অনুসারী না হয়। বাস্তবানুগ হয়। কারণ দেখেছি বহু মহাপুরুষই বাবা-মাকে ঈশ্বরতুল্য জ্ঞানে সেবা করার জ্ঞান আজীবন দিয়ে যাওয়ার পরও নিজের সন্তানদের আর সু-নাগরিক গড়ে তুলতে পারেননি।
২) সম্পর্কের মধ্যে একটা সীমারেখা গড়ে দেওয়া। এবং তাকে আচরণে প্রতিষ্ঠিত করা। একটা বয়সের পর যদি ব্যক্তিগত জীবনে, বৈবাহিক জীবনে, কাজের জীবনে, কি সামাজিক জীবনে বাবা-মা "ভালো করার" জন্য উপদেশ দিতে আসেন, তবে সসম্মানে তাকে সীমারেখা বুঝিয়ে দেওয়া। এটা খুব দরকার।
৩) বাবা মা-কে পরিবর্তন করতে যাওয়ার চেষ্টা করতে যাওয়া বোকামি। একটা বয়সের পর তারা আর বদলাবেন না, সেটাই স্বাভাবিক। আর অকারণে তাদের সঙ্গে তর্কে জড়িয়েও লাভ নেই। কারণ খানিকবাদেই যুক্তির থেকে আবেগের দৌরাত্ম শুরু হবে, যুক্তির ছদ্মবেশে, সঙ্গে নানা ধরণের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল। অগত্যা স্থান ত্যাগ করো। বেরিয়ে এসো। অল্পদিনের জন্য, না বেশিদিনের জন্য সে পরিস্থিতির উপর নির্ভর করবে।
৪) নিজের যত্ন নিতে শেখা। এটা খুব দরকার। প্রথমেই আবার প্রথম কথাটা, নিজের ভিতর থেকে যাবতীয় অপরাধবোধ, হীনমন্যতাবোধ যা টক্সিক বাবা-মা থেকে পরোক্ষভাবে পাওয়া, সুকৌশলে চারিয়ে দেওয়া, তার থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হবে। নিজের সামাজিক পরিমণ্ডল নিজের রুচি অনুযায়ী বানিয়ে নিতে হবে। নিজেকে নিজের দায়িত্বে শিক্ষিত করতে হবে, ইমোশনালি স্বাবলম্বী করতে হবে।
ওয়েবমেড, সাইকোসেন্ট্রাল, উইকিহাও ইত্যাদি পেজের থেকে মোটামুটি এ ধরণের পরমার্শ আছে।
এখন আমাদের কালচারে এ সব কথা অনেক সময়েই "স্বার্থপরতা"..." রুডনেস"... "অকৃতজ্ঞ"...." যেমন বউ শেখাচ্ছে, বন্ধুবান্ধব শেখাচ্ছে".... ইত্যাদি নানা অবাস্তব নিন্দামন্দের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। ফলে এক একজন মানুষের নিজের সন্তানের কলেজ পাশ করার বয়সেও নিজের বাবা মায়ের এই টক্সিসিটি বোঝার ক্ষমতা থাকে না।
ভালো করে বুঝে দেখতে হবে টক্সিসিটিটা বাবা মায়ের মধ্যে দিয়ে এলে সেটা কি ভয়ানক হতে পারে। বহু মানুষের জীবন আজীবনের মত পঙ্গু হয়ে যেতে দেখেছি, এই অতিভালোবাসা, অতিদাবীদাওয়া, অতিঘনিষ্ঠতা, প্রাইভেসির মা-বাপ এক করে দেওয়া বাবা মায়ের কল্যাণে।
বাবা মায়ের উপর শ্রদ্ধা ভালোবাসা কর্তব্য সব থাকবে। কিন্তু পাশাপাশি এটাও খেয়াল রাখতে হবে সে টক্সিক বাবা মায়ের সন্তানদের সমালোচনার আগুনে আরো না সেঁকে, তাদের ভালো করে বুঝতে চেষ্টা করা যে কি ভাগ্যহীন তারা। যে ভালোবাসার সম্পর্কের আশ্রয়ে জীবনের প্রথম চোখ ফোটে, সেই ভালোবাসাই যখন টক্সিক হয়, সে দুর্ভাগ্য কি সাংঘাতিক দুর্ভাগ্যই না হয়!
যদি উদাহরণ দিতে বসি, তবে মহাভারত লেখা হয়ে যাবে। মোদ্দাকথা এই, একটা বয়সের পর নিজের সম্মানের সঙ্গে আপোষ কোনো কাজের কথা নয়। আর সেটা যদি বাবা মায়ের থেকে আসে তবে তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের হলেও, বাস্তব। তাকে মেনে নিয়ে এগিয়ে যাওয়াটাই নিজের প্রতি নিজের সুবিচার। নইলে মেরুদণ্ডহীন, স্বাতন্ত্র্যবোধহীন "বাবা মায়ের বাধ্য ও ভালো সন্তান" হয়ে বেঁচে থাকা নরক যন্ত্রণার সামিল হয়ে দাঁড়াতে পারে।
"আমার সব ঘরে ঘরে গিয়ে দেখতে ইচ্ছা করে, তোমার মত এরকম কত মা তাদের কত মেয়ের জন্য এরকম করে.... তোমাদের ভালো করার এই মারাত্মক ভুলে সমস্ত জ্বলে পুড়ে সব শেষ হয়ে গেল।"
(ছবিটা কালজয়ী বাংলা সিনেমা 'সাত পাকে বাঁধা'-র। শিরোনামটাও এই সিনেমারই একটা সংলাপ।)