Skip to main content

 “ — মল্লিক, আমার খেতে বেলা হয় বলে, রাঁধবার বামুন ঠিক করে দিছল। একমাস একটাকা দিছল। তখন লজ্জা হল। ডেকে পাঠালেই ছুটতে হত। — আপনি যাই, সে এক।…. এই অবস্থা যাই হলো, রকম-সকম দেখে অমনি মাকে বললাম — মা, ওইখানেই মোড় ফিরিয়ে দাও! — সুধামুখীর রান্না — আর না, আর না — খেয়ে পায় কান্না!”

    এ কথাটা এক স্বাধীনচেতা মানুষের। যে ভালোবাসার দান নেয়। যে ন্যায্য উপার্জন নেয়, কিন্তু নিজের সুবিধার জন্য কারোর কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিতে রাজী নয়। 

    অগত্যা কি হল, রাঁধুনিকে আর রাখা হল না। খেতে দেরি হয় হোক, কিন্তু বশ্যতা নয়। 

    মজার কথা হল দেশটা তখন স্বাধীন নয়। হাজার হাজার মানুষ সাহেবি বশ্যতা স্বীকার করে নিয়ে নিজের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা শুধু না, নিজের সুখ বিলাসের ব্যবস্থাও করছে। সে সময়ে দাঁড়িয়ে এত আত্মসম্মানের বোধ এনার জন্মালো কি করে? এমন তো নয় উনি পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত, ওদের ব্যক্তিস্বাধীনতা ইত্যাদি মত সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। তা তো নয়! জম্মেছেন তো কামারপুকুর নামক ওই অজ গ্রামে। আর যে কাজ করতে কলকাতায় আসা সেও যে খুব উঁচুস্তরের তাও তো নয়। তবে এত স্বাধীনসত্তা জন্মায় কি করে? এত আত্মমর্যাদার মূল কি?

    এর কারণ রামকৃষ্ণদেব তাঁর উপলব্ধিকে সত্য করে জেনেছিলেন। কোনো কিছু পাওয়ার উপযোগী মাধ্যম হিসাবে না। তিনি কোথাও বলেননি ধর্মের মাধ্যমে সমাজে অমুক হবে, তমুক হবে। তিনি বলেননি যে অমুক বিজ্ঞানী, কি তমুক বড় মানুষ ধর্মকে সত্য বলেছেন বলে এটা সত্য। এ সব উনি বলতেন না। বরং ধর্মকেই বলতেন বালিতে চিনিতে মেশানো। বলতেন, সব ধর্মেই গোলমাল আছে। আমি আমার গভীরের সত্যকে অনুভব করেছি। তাকে 'মা' বলে জেনেছি। তোমায় যে আমার সঙ্গে মিলতেই হবে তার কোনো মানে নেই। শুধু বোলো না যে তোমারটাই সত্য আর আমারটা মিথ্যা। তবেই হল। 

    বার্ট্রান্ড রাসেল বলছেন, যিনি ধর্মকে সত্য বলে জানেন আমি তার সঙ্গে কথা বলতে রাজী, কিন্তু যিনি ধর্মের দ্বারা সমাজে অমুক তমুক উপকার হবে বলে চালাতে চান, আমি তার সঙ্গে কদাপি কথা বলতে রাজি নই। 

    কোনো কিছুকে যদি আমি সত্য বলে অনুভব করি তবে সেই অনুভবের সঙ্গে সঙ্গে আমার মধ্যে এক আত্মমর্যাদাবোধ তৈরি হয়। যিনি অর্থকে সত্য বলে জানেন, তিনি অর্থনীতিবিদ হন, তিনি ধনসম্পদ জমিয়ে কুবের হয়ে যান না। যে কুবের হয় তার কাছে অর্থ লোভের বস্তু, সত্যবস্তু নয়। আমি যাকে ভালোবাসি সে যদি আমার ভালোবাসার সত্য হয় তবে আমি সুখে-দুখে রোগে-স্বাস্থ্যে, সম্পদে-বিপদে তাকে ছাড়ার কথা ভাবতে পারি না। কিন্তু সে যদি আমার সুখের বস্তু হয়, ভোগের বস্তু হয়, তবে কিছু সমস্যা হলেই আমি তাকে ছাড়তে পারি অনায়াসে। যাকে ভালোবাসি দরকার হলে তার থেকে দূরত্ব রাখতে পারি ভালোবাসার মান রাখতে। কিন্তু সে যদি ভোগের হত তবে সে দূরত্বে আমার ক্ষোভ হত, রাগ হত, বিরহ জন্মাত না। 

    রামকৃষ্ণদেব সত্যকে অনুভব করেছিলেন। তাই অর্থ, মান, সম্মান, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির তোয়াক্কা করেননি। কারণ সত্যেই সত্যের প্রয়োজন শেষ হয়। যিনি মহাকাশ নিয়ে গবেষণা করেন যদি ভাবি তার কাজ শুধুমাত্র জোয়ারভাঁটার হিসাব রাখা, যাতে আমার স্নানে যেতে সুবিধা হয়; কিম্বা গ্রহণের খবর রাখা, বা ধূমকেতু এসে কবে আমাদের ধংস করবে সে-ই খবর রাখা, তবে আমরা সেই মহাকাশবিদকে অপমান করি না শুধু, তার অধীত বিদ্যাকেও অসম্মান করি। সত্যের খোঁজ সত্যতেই শেষ। সে কোনো কিছুর উপযোগী হোক চাই না হোক তাতে কিছু আসে যায় না।

    আবার দুজন মহান দার্শনিকের কথায় আসি। বার্ট্রান্ড রাসেল তার শেষ সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এই সত্যই শেখাচ্ছেন, সত্যকে সত্য হিসাবেই মেনে নেওয়ার। আর রাসেলের বহু আগে আরেক যুগান্তকারী দার্শনিক ইম্যানুয়েল কান্ট বলছেন যে, সব নীতির মূল কথা ও শেষ কথা নীতিই। ক্যাটাগোরিকাল ইম্প্যারেটিভ শেখাচ্ছেন কান্ট। কিছু সুবিধা অসুবিধা হবে বলে নীতি না। রামকৃষ্ণদেব বলছেন, খানদানি চাষার কাজই হল চাষ করে যাওয়া, সে বৃষ্টি হোক চাই না হোক। "কি দিবে ধর্ম তব? দুঃখ নব নব", রবীন্দ্রনাথ গান্ধারীর মুখ দিয়ে বলিয়ে নিলেন। 

    জীবনকে যদি রামকৃষ্ণদেবের ভাষায় মানে আর হুঁশে সত্য বলে জানি, তবে যে কোনো অবস্থায় নিজেকে নিয়ে চলায় কোনো ক্ষোভ জন্মায় না। নিজের মান আর হুঁশকে জাগিয়ে রাখাই তখন আমার প্রধান কর্তব্য। কিন্তু জীবনকে যদি নানা ভোগের নিমিত্ত এক উপায় ভাবি, তবে আমার ক্ষোভের আর সীমা-পরিসীমা থাকে না। আজ সুখের উত্তুঙ্গ শিখরে, তো কাল বিষাদের ঘন অন্ধকারে। সে জীবনে সহজ আনন্দ কোথায়? তখন এক বিষাদ থেকে আরেক বিষাদে জীবনের সুড়ঙ্গগামীতা। সত্য সাধনায় আত্মমর্যাদাবোধ আছে। সে কঠিন। তাই সে সত্য। "সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, সে কখনো করে না বঞ্চনা।" রবীন্দ্রনাথ। "সত্যতে থাকলে ঈশ্বরলাভ হয়"। রামকৃষ্ণদেব।