বিবেকানন্দের ভারতবর্ষের সাথে আমার ভারতবর্ষের মিল কোথায়? তাঁর আত্মজ্ঞান, নিঃস্বার্থপরতা, ধ্যানপরায়ণতা, সৎ-সাহসিকতা, ধর্মে যুক্তিপরায়ণ হওয়ার চেষ্টা, সর্বোপরি দেশের প্রতি সর্বগ্রাসী ভালোবাসা - এ সব তো মিউজিয়ামে দেখতে যাওয়ার বস্তু আজ। আর বাকি যতটুকু বিবেকানন্দ পড়ে থাকে সে তো ‘ব্র্যাণ্ড বিবেকানন্দ’ - রাজনীতির, ক্লাবনীতির, মঠ-মিশন নীতির ইত্যাদি। প্রাণ কই? রামকৃষ্ণ মিশন থেকে যে পত্রিকাগুলো বেরোয়, তাতে গত বারো বছরের মধ্যে নতুন চিন্তাধারা কই? গত দশ বছর আগের ‘উদ্বোধন’ পত্রিকার সাথে আজকের পত্রিকার কোনো পার্থক্যই করতে পারি না, কেবল মলাট আর নামগুলো পরিবর্তন ছাড়া। নতুন ধরণের কালোপযোগী চিন্তা-ভাবনা কই, যা যুব সমাজকে আকর্ষণ করবে? বিবেকানন্দ, তাঁর গুরু ও গুরু মা যে খুব ভালো মানুষ ছিলেন সে নিয়ে কোনো সংশয় নেই। কিন্তু তাঁরা যে অসম্ভব সাহসী ছিলেন, এই কথাটা যেন আমরা মনে রাখতে চাইছি না। নতুন ধরণের চিন্তা, সমালোচনার ধার দিয়ে হাঁটার শক্তি বা সাহস যেন তাঁদের উত্তরসূরী বলে দাবিদারদের লুপ্ত আজ। সব অবশেষে সেই – Holier than thou কৌটোতে ঢুকে পড়েছে।
বিবেকানন্দ তথা শ্রীঅরবিন্দের উচ্চারণে 'শ্রদ্ধা' শব্দটা বারবার ঘুরেফিরে এসেছে। ওই শব্দটাই যেন তাঁদের দর্শনের, বিশ্বাসের ভিত্তিপ্রস্তর। এমনকি দু’জনেই এই শব্দটাকে ইংরাজীতে অনুবাদ করার মত কোনো শব্দও স্বীকার করেননি। বরং ব্যাখ্যা করে বোঝাতে চেয়েছেন 'শ্রদ্ধা' বলতে আমরা কি বুঝি। উপনিষদে শ্রদ্ধাকে আহ্বান করার প্রার্থনা আছে। সেখানে ঋষি শ্রদ্ধাকে প্রভাতে, দ্বিপ্রহরে, সন্ধ্যায় নিজ জীবনে অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য প্রার্থনা জানাচ্ছেন। এই ‘শ্রদ্ধা’ কি ফাঁকিতে পাওয়ার বস্তু? কয়েকটা ভাষণ, কয়েকটা প্রস্তরমূর্তি (রবীন্দ্রনাথ যাকে বলতেন পাথরের পিণ্ডিদান) ইত্যাদি দিয়ে সে রিক্ততাকে ঢাকা সম্ভব? বিবেকানন্দ এক জায়গায় বলছেন, 'আমি ভারতকে যুক্তিবাদী করতে চাই'। কিন্তু তিনি চাইলে কি হবে, আমরা কি চাই? ‘যুক্তি’ আর ‘শ্রদ্ধা’ কি দুটো স্ববিরোধী শব্দ? না। ঠিক সেই কারণে একজন চিকিৎসককে একটা শপথ বাক্য উচ্চারণ করে চিকিৎসার জগতে পদার্পণ করতে হয়। দেশনেতাকে একটা শপথ বাক্য উচ্চারণ করে দেশসেবার ভার নিজের হাতে তুলে নিতে হয়। এই শপথটাই হল শ্রদ্ধা। আমাদের জীবনের হাল। আমাদের শাস্ত্র বলেন, তিনি তেমনই হবেন যেমন তাঁর শ্রদ্ধা।
বিবেকানন্দ ও তাঁর ভাবশিষ্য নেতাজী বারবার উল্লেখ করেছেন, তোমাদের মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ কমছে, একটা সবকিছুকে হেসে উড়িয়ে দেওয়ার ভাব এসে পড়েছে... এটা বিপজ্জনক।
এটা যে বিপজ্জনক সেইটাই যে আমাদের বোধে নেই, সেটা যে আরো কতবড় বিপজ্জনক তা বোধ করবে কে? শ্রদ্ধা কোনো অতীন্দ্রিয় জগতের জন্যে রক্ষিত বিশেষ এক প্রকার বর্ম না। শ্রদ্ধা আমার মানুষ হিসাবে নিজেকে দেখার মূল্যায়ণ। একজন অতিশিক্ষিত মানুষ যে কারণে অনায়াসে অসৎ হয়ে যায়, আর একজন স্বল্পশিক্ষিত মানুষ সততার মাটি আঁকড়ে থাকেন - তার কারণ এই শ্রদ্ধার তারতম্যতা। কোনো স্বর্গবাসী দেবতার প্রতি না। নিজের প্রতি। আত্মশ্রদ্ধা যার আছে তার হাত, তার পা, তার চোখ, সর্বোপরি তার মন কোনোদিন অবিবেকের রাস্তা মাড়ায় না। সে মহাপুরুষ হবে বলে না, সে নিজেকে অত ছোটো দেখতে পারে না বলে। রবীন্দ্রনাথ তাই যখন বলেন, 'সে পথে মানুষ অনেক সঞ্চয় করেছে, জমিয়েছে... তবু বলি সে পথ তোমার না হউক...' তখন এ আর্তি আমার আত্মশ্রদ্ধার কাছে তাঁর; আমার ভিতরের স্বার্থলোভী হিসেবী ছোটো মানুষটার কাছে না, যে শ্রদ্ধাবোধটাকে কুকুরের মত শুঁকে দেখে ও দিয়ে টাকা হয় কিনা?
বিবেকানন্দের তাই কোনো ঈশ্বর ছিল না মানুষ ছাড়া। দেশকে খুঁজতে গিয়ে পেয়েছিলেন ভারতাত্মাকে। ভারতাত্মার মধ্যে পেয়েছিলেন অখিল মানবাত্মাকে। মহামানবের পদধ্বনি শুনতে পেয়েছিলেন আমাদের মত অজস্র লক্ষকোটি সাধারণ মানুষের মধ্যে। বারবার স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন আমার ভিতরের আমার মহত্ত্বকে আমার পূর্ণতার অনুভবকে। তাকে জাগাবার উপায় স্বরূপ বলে গেলেন - ধর্ম আর শিক্ষাকে। যে ধর্মের প্রথম আর শেষ কথা মানবাত্মার মহত্ত্ব। আর যে শিক্ষার মূল সুর চিত্তের প্রসার। বারবার বুঝিয়ে গেলেন, মানুষ নিজেকে ধ্বংস করে বসে ঈশ্বরকে অস্বীকার করে না, নিজেকে অস্বীকার করে। তাই বলে গেলেন, এ যুগে যে নিজেকে বিশ্বাস করে না সেই নাস্তিক। নিজেকে বিশ্বাস অর্থে নিজের মহত্ত্বে বিশ্বাস। “তিনি বলে গেলেন আমায়, নিজেরে নিন্দা কোরো না... সে যে পাপ!” রবীন্দ্রনাথ গাইলেন চণ্ডালিকায়।
আজ তাই মনে হয় সেই প্রাচীন যুগের চিরকালীন প্রার্থনাকে নিজের চিত্তে নিভৃতে জাগিয়ে তুলি -
হে শ্রদ্ধা, তুমি আমার চিত্তে প্রভাতে এসো
হে শ্রদ্ধা, তুমি আমার চিত্তে দ্বিপ্রহরে এসো
হে শ্রদ্ধা, তুমি আমার চিত্তে সন্ধ্যায় এসো
হে শ্রদ্ধা, তুমি আমার চিত্তে নিশীথে এসো
(ছবিঃ ইন্টারনেট)