জগন্নাথের সামনে দাঁড়িয়ে। জীবন্ত দুটো চোখ। কি চাওয়ার আছে?
একদিন খুব বৃষ্টি। গাছের নীচে দাঁড়িয়ে। সন্ধ্যে হয়ে গেছে। রাত বাড়ছেই বলা চলে। সামনের ধানক্ষেতটা ঝাপসা হয়ে আছে। পিঠে ব্যাগ। পড়ে ফিরছে। হঠাৎ খুব জোরে বাজ পড়ল। তখন তো মোবাইল ফোন ছিল না। তার মনে হল সে মরে যেতে পারে এখনই। এই মুহূর্তে।
বৃষ্টি থামল। কিন্তু তার সারাটা শরীর অবশ। নড়তে পারছে না। তার শুধু মনে হচ্ছে সে তো মরে যেতেও পারত। এখনই বাজ পড়ে সব শেষ হয়ে যেতে পারত। বাড়িতে মা, বোন, ভাই, ঠাকুমা, ঠাকুর্দা… কারোর সঙ্গে আর দেখা হত না!
মেঘ কেটে চাঁদ উঠেছে। সামনে ক্ষেতটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ফাঁকা রাস্তা। সে গাছতলায় দাঁড়িয়ে অবশ। কে বাঁচালো তাকে? কেন বাঁচালো?
এরপর আরো কয়েকবার মৃত্যুকে সামনাসামনি দেখেছে। আজ চোখের সামনে জীবন্ত দুটো চোখ। জগন্নাথের চোখ। চোখের আশ্রয় বলে কি কিছু হয়? শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেন হয়। একটা সাক্ষাৎকারে শুনেছিল সে। তিনি বলছেন, জীবন বিষণ্ণতায়, অবসাদের ঘোর বিপন্নতায় এসে ঠেকেছিল। একজোড়া চোখের দৃষ্টি তাঁকে বাঁচিয়েছিল। বাঁচার আশা জুগিয়েছিল। দেওঘরে। তাঁকে সেইদিনই তিনি মনপ্রাণ সব সঁপে দিয়ে এসেছিলেন। কিছু অনুভব তর্কাতীত হয়। এখন যেমন হচ্ছে। জীবন্ত দুটো চোখ যেন ওই গর্ভগৃহে নয়, তার বুক ফুঁড়ে জেগে আছে। তার মন-প্রাণ-বুদ্ধি সব ভেদ করে তাকিয়ে আছে। সে যেন মিশে যাচ্ছে চোখের মধ্যে। দৃষ্টির সাগর হয়? কারোর দৃষ্টি বড় সঙ্কীর্ণ। কারোর দৃষ্টিতে সাগর। সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিতে সঙ্কুচিত প্রাণ। ভয়, অবসাদ আর বিষাদের বাসা। ভালো না সে। বড় দমবন্ধের। এ দৃষ্টি সমুদ্রের মত বিশাল। গভীর।
শীর্ষেন্দুবাবু বলেছিলেন, সে দৃষ্টিতে তাঁর মনে হয়েছিল যেন গাভী যেমন তার বৎসকে জিভ দিয়ে চেটে দেয়, শুশ্রূষা করে, তিনি তেমনই শুশ্রূষা পেয়েছিলেন। শান্ত হয়েছিলেন। যে মানুষ আত্মহত্যার সিদ্ধান্তকে ডানহাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে ঘুরছে, সে মানুষের মুঠো খুলে গেল। গড়িয়ে গেল সিদ্ধান্ত। হারিয়ে গেল। আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত হয় না। মনে হয় ওটা বিকল্পহীন পথ। পেরোতেই হবে। সব মানুষই আত্মহত্যার পথ বাছে পেরিয়ে যাবে বলে। কিন্তু পেরিয়ে তো যাওয়া যায় না কোথাও, আচমকা থেমে গিয়ে।
জীবন্ত চোখদুটোতে কি আছে? এই যে সামনে সমুদ্র। ওই যে ওপারে বিস্তীর্ণ অন্ধকার। এই যে ঢেউয়ের পর ঢেউ ভাঙছে। এর কি কোনো মানে আছে? যুগের পর যুগ এ ঘটেই চলেছে। এমনভাবেই সারাটা আকাশ নিত্য তারার মজলিস সাজিয়ে বসছে। এর কি কোনো মানে আছে? আসলে মানে খোঁজার দায় তো আসলে মানুষেরই! কিন্তু যদি মানে না খোঁজে? শুধুই তাকিয়ে দেখে। সেই অর্থ না খোঁজার দৃষ্টির সামনে ধরা দেয় এক রহস্য। কি সেই রহস্য? তার অর্থ খোঁজা যায় না। সে বোধের মধ্যে চাবি ঘোরায়। একটার পর একটা তালা খুলে যায়। গভীরতা বাড়ে। শান্তিজল এসে প্রাণের তটে ছোঁয়। যে শান্তিতে তার জন্মগত অধিকার। যে শান্তিকে ফিরিয়ে দেওয়াও তার জন্মগত ক্ষমতা।
ওই যে বাচ্চাটা বালি তুলে মুঠো ভরে ঘর বানাচ্ছে। রাস্তা বানাচ্ছে। পুকুর বানাচ্ছে। ওর ওই মুঠোতে কতটুকু বালি ধরে? কতক্ষণের স্থায়িত্ব তার ওই নির্মাণের? তবু তার এই ক্ষুদ্র সুখের অনুমতি আছে। ক্ষুদ্র সময়ের গণ্ডীতে।
কতটুকু মুঠো তোমার? জানো কি কতটুকু সময়ের অনুমতি তোমার? কেউ জানে না। ওই যে দুজোড়া চোখ, সেও ব্যস্ত নয় তার মহাকালের জ্ঞানভাণ্ডার নিয়ে। সে শুধু ক্ষণকালে মহাকালের নূপুর বাজিয়ে ফিরছে। সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের। রুদ্র তাণ্ডবে, বাঁশির মাধুর্যে। তার কোনো অর্থ হয় না, মুঠোয় ভরার। না তো সে অর্থহীন, সুতো ছেঁড়া ছড়িয়ে পড়া মুক্তোর মত।