Skip to main content

ওগো নিঠুর দরদী.. অতুলপ্রসাদ লিখলেন। এই নিঠুরতা কে অনুভব করে? যে কেউ? না, যে ভালোবাসে। ভালোবাসার ব্যথা অনেক। না ভালোবাসার ব্যথা নেই। ভালোবাসার ব্যথা মাটির গন্ধের মত। সে যেমন থেকেও নেই। কিন্তু যেই না বৃষ্টির জল এসে পড়ল, সে জেগে গেল, এও তেমন।   

ভালোবাসা যদি আবহাওয়া অফিসে খবর দিয়ে আসত? কত ভালো হত। যেমন ঘূর্ণিঝড়ের খবর আসছে শুনলেই লোকজনকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়, তেমন নিজের যা কিছু দামী, মূল্যবান সব সরিয়ে নেওয়া যেত! বাঁধ দেওয়া যেত!

কিন্তু তা তো হওয়ার নয়। দেখতে দেখতে মেঘ জমে যাবে, কত কিলোমিটার বেগে বাতাস বইতে পারে সে আন্দাজ পাওয়ার আগেই সব তছনছ হতে শুরু। সে সুখ, না দুঃখ সেও বোঝার উপায় নেই। শ্রবণজুড়ে কেবল সাঁ সাঁ শব্দ। দৃষ্টিজুড়ে শুধু কি ভয়ংকর সুন্দর মুখ, ঝড়ের মুখ। সব নাও, সব নাও। মৃত্যু তখন কুশাঙ্কুর। মৃত্যু তখন নেশা। মৃত্যুর চোখের উপর চোখ রেখে বলা, আয় আয়, নে আমাকে।

তারপর হঠাৎ একদিন ঝড় শেষ। সব এলোমেলো। তছনছ। নিজের সারাটা শরীর ছিন্নভিন্ন এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। সদ্য জন্মানো শিশুর মত কুঁকড়ে একদিকে পড়ে আছে ও কে? হৃদয়।

কেউ কেউ এই সময়ে হেরে যায়। বলে সব যখন গেল, আমিও যাই। সে ঝড় খুঁজতে বেরোয়। ঝড়ের কাছে নালিশের খাতা নিয়ে যেতে চায়। হিসাব করে দেখাতে চায় তাকে, কি কি ক্ষতি সে করে গেল। কিন্তু ঝড় কি খোঁজার জিনিস! সে তো অনাহূত। সে তো আমায় খুঁজে নেবে। আমি তাকে খুঁজলে সে হবে এক চিলতে হাওয়া। সে অভিমানী। সে বলে, আমায় খুঁজে নেবে তুমি? বেশ আমি তোমার বশে থাকব আজ থেকে। উফ, কি অসম্ভব একঘেয়ে, প্রাণহীন সে মুহূর্তগুলো হতে থাকে। পোষা কুকুরের মত সে আশেপাশে ঘোরে, বল ছুঁড়ে দিলে নিয়ে আসে। কখনও 'না' বলে না কোনো কিছুতেই। ক্লান্তি ঘিরে ধরে। মালিক আর কুকুর একই সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ে কখন। ভালোবাসাকে খুঁজে নিলে, সে এভাবেই শাস্তি দেয়, নিজেকে অধীন করে দিয়ে, সব কিছুকে মিথ্যা করে দেয়।

আবার আগের দৃশ্যে আসি। সব কিছু তছনছ পড়ে। চারদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। গর্ভছিন্ন ভ্রূণের মত কুঁকড়ে শুয়ে, হৃদয়। কেউ কেউ হেরে যায় না। সে উঠে বসে মায়ের মত। এক একটা অঙ্গ জড়ো করে। হৃদয়কে খুব আলতো হাতে তুলে, পরম স্নেহে তার শুশ্রূষা শুরু করে। শুশ্রূষা মানে তাকে চোখে চোখে রাখা। কেউ ডাকতে এলে বলে, এখন আমার সময় নেই। কেউ সান্ত্বনা দিতে এলে, সে হেসে বলে, আগে ঝড় তোমার অতিথি হোক বন্ধু, তবে এসো সান্ত্বনা দিতে। তখন সে সান্ত্বনাদাতা কখনও কখনও বলে, আমার পরম সৌভাগ্য আমার ঘরে ঝড় আসে না। আমার ক্ষেতজুড়ে সোনার ফসল। আমার গোলা ভরা ধান। আমার পুকুরজোড়া মাছ। আমায় গোয়াল ভরা গরু। আমি সুখী। ঝড় যে আসবে আমি সে সুযোগই দিই না। আমার হৃদয়ের গন্ধ আমি ঘুঁটের ধোঁয়ায় আড়ালে রাখি। সে গন্ধ না পেলে ঝড় আসে না, জানো না যেন!

জানি। তুমি সুখী হও। তোমার সুখে আমার সুখ নেই। আমার হৃদয়ের গন্ধ আবার বেরোবে বন্ধু। সে আবার ঝড়কে টেনে আনবে। তুমি আমার থেকে থাকো দূরে। ঝড়ের পরিধির হাওয়াও যেন না লাগে তোমার সুখে। তুমি সুখ বাঁচাও। আমি মরি।

সময় যায়। সব আবার আগের মত হয় না, তাই কি হয়! আগের ঝড়ের দাগ তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জুড়ে। ততদিনে হৃদয় আবার উঠানজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। চলতে ফিরতে তার মাঝে মাঝে হাঁপ ধরে, সে আগের ধাক্কার স্মৃতি। সে নিজেকে বলে, আমি ফুরিয়ে যাব, কিন্তু পাঁচিল তুলে নির্জীব হব না, পঙ্গু হব না। ঘায়েল হব বারবার।

আবার ঝড় আসে। ওই যে বললাম, এ ঝড় কখনও আবহাওয়া অফিসে খবর দিয়ে আসে না। এলে কি ভালো হত? কোনোদিন না।