Skip to main content


অনেকদিন আগের ঘটনা। স্কুলে পড়ি। দূরদর্শনে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্ঠে রবীন্দ্রসংগীত হচ্ছে। মনোযোগ দিয়ে শুনছি। গান শেষ হল, আমার পাশে বসা একজন কাকু বললেন, বল তো উনি যে শাড়িটা পরেছিলেন তার দাম কত হবে? আর ওনার পায়ের কাছে যে কার্পেটটা রাখা ছিল তার দাম কত আন্দাজ কর তো?
        আমার খুবই করুণ দশা হল। শিল্পী যে শাড়ি পরেছিলেন সেই নিয়ে আমার কোনো সংশয় নেই, কিন্তু তাঁর সামনে যে কার্পেট রাখা ছিল সেটা তো খেয়াল করা হয়নি।


        এই কথাটাই বলবার জন্য বসা। আমরা যা কিছু পর্যবেক্ষণ করি, তা কি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ? মনোবিদরা বলেন, না। আমাদের মনোরাজ্যের একটা নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দের ক্ষেত্র আছে, যাকে তারা স্কিমা (Schema) নামে অভিহিত করেন। অর্থাৎ, আমি তাই মনে রাখি যা আমি মনে রাখতে চাই। তবে একটা কথা আসতে পারে, তাহলে আমরা দুঃখজনক ঘটনা, পীড়াদায়ক স্মৃতি ধরে রাখি কেন? প্রথমত, এই ধরে রাখা / না রাখাটা আমাদের ইচ্ছা/অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে না। আমাদের স্কিমাই সেটা নির্ধারণ করে দেয়। তাই নেগেটিভ ইমোশান বা নেগেটিভ স্মৃতিগুলোর পোষণের ক্ষেত্রে মরবিড, বেদনাবিলাসী ইত্যাদি স্বভাবের কথাও আমরা জানি। যে স্বভাবটাও তার হাতে নেই। সব স্বভাবই যদি বদলানো যেত তবে আর জেলখানার প্রয়োজন হত না। চূড়ান্ত অপরাধপ্রবণ ব্যক্তি আর অত্যন্ত সৎ ব্যক্তি – দু'জনেই তাদের স্বভাবের শৃঙ্ক্ষলে আবদ্ধ। এ কথাটা আমার না, স্বামীজির। তিনি বলছেন, এই যে আমি ভালো ভালো কথা বলছি তোমাদের সামনে, আর কেউ হয়ত চুরি করছে --- আমরা দু'জনেই আমাদের স্বভাবের দাস। আমি ভালো না বলে থাকতে পারি না, আর সে না চুরি করে থাকতে পারে না।
        তাই আমাদের সমাজ অপরাধীর বিচারের সোজা পথটাই বেছেছে। অপরাধের চিকিৎসা করার দায় নেয়নি। সে অত্যন্ত কঠিন, সময়সাধ্য, বিপদসঙ্কুল পথ। ‘সংশোধনাগার’ -এর বাস্তবায়িত রূপ যদি সত্যিই আকাঙ্ক্ষানুরূপ হত! গুগুল-এ কোনো ইংরাজি শব্দের অর্থ খুঁজতে গেলে, সেই অর্থের সময়ের সাথে ব্যবহারের গ্রাফ দেখায়। দেখছিলাম, insecurity শব্দটা ১৮০০ সালে যে পরিমাণ ব্যবহৃত হত, ২০১০ -এ তার ব্যবহারের মান প্রচুর বেড়ে গিয়েছে।
        একটা পরীক্ষার কথা শুনেছিলাম। একটা ঘরকে অফিসরুমের মত সাজানো হল। তাতে অফিসে যা যা থাকে, চেয়ার টেবিল কম্প্যুটার ইত্যাদি সবই রাখা হল, কিন্তু তার সাথে একটা খুলি আর একটা সাঁড়াশিও রাখা হল। ঘরে তিরিশজনকে কিছুক্ষণ রেখেই বাইরে নিয়ে আসা হল। তারপর তাদের প্রত্যেককে যখন আলাদা আলাদা করে ঘরের সামগ্রীর তালিকা বলতে বলা হল, আশ্চর্যজনকভাবে দেখা গেল, মাত্র ৮ জন খুলি আর সাঁড়াশির কথাটা বলতে পারলেন, বাকিরা পারেলনই না। তার কারণ মনোবিদদের ব্যাখ্যায়, আমাদের অফিস বলতেই একটা স্থির ধারণা মাথার মধ্যে আছেই, তার বিপরীতে কিছু গেলেই সে আর তা গ্রহণ করবে না। তাই খুলি আর সাঁড়াশিটা অতজনের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল।


        তবে আমাদের পর্যবেক্ষণের নির্ভরযোগ্যতা কতটুকু? অথচ আজ আমাদের যা কিছু অগ্রগতি তার মূল উদ্দীপক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই পর্যবেক্ষণ। যদি সব পর্যবেক্ষণই পক্ষপাতদুষ্ট তবে দাঁড়ানোর জায়গা কোথায়? এইখান থেকেই আমি মনোবিদদের থেকে বিচ্ছিন্ন হলাম। পর্যবেক্ষণের অর্থ কি? তার মূল উপাদান কি?
প্রথমেতেই দ্বিতীয়ের উত্তর আছে – মন। তার গভীর সংযোগই পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণ। ধরি স্টেশানে বসে আছি। ট্রেন আসতে ঢের দেরি। আমার হাতে বেশ কিছুটা বাড়তি সময়। আমি চেয়ারের পাশে হেঁটে চলা একটা পিঁপড়েতে মনোসংযোগ করেছি। একটা পিঁপড়ে আছে, আমার একটা মন আছে আর আমি – দ্রষ্টা হিসাবে আছি। আমি পিঁপড়েটার বাসস্থান, চলার গতি, গায়ের রঙ ইত্যাদি বেশ খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলাম, তাতে নিজের মধ্যে একটা আমোদ অনুভব করলাম। এটা একধরণের পর্যবেক্ষণ।
        অন্যভাবে ভাবা যাক। প্রেক্ষাপট একই। আমি পিঁপড়েতে মনোযোগ না দিয়ে, মনের আগাম কোনো সমস্যার ভাবনায় ডুব দিলাম। সেটা ব্যক্তিগত, পরিবারগত, জীবিকাগত, রাজনীতিগত, খেলাগত ইত্যাদি যা খুশীই হতে পারে। সেখানে সমস্যাটা পিঁপড়ের জায়গায়, মন আছে, দ্রষ্টা হিসাবে আমিও আছি। কিন্তু একটু পার্থক্য আছে। পিঁপড়ের সাথে দ্রষ্টার কোনো সম্পর্ক ছিল না, এখানে সমস্যার সাথে দ্রষ্টার সম্পর্ক আছে। তাই এইক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ শব্দটা আগের উদাহরণের সাথে প্রয়োগগত অনুরূপ হলেও ফলাফলত অনুরূপ নয়। আগের পর্যবেক্ষণের সাথে আবেগজনিত সমস্যা ছিল না। এইক্ষেত্রে আছে। পর্যবেক্ষণকে পথভ্রষ্ট করে দুশ্চিন্তার জটাজাল তৈরি করতে থাকবে আমারই আবেগময় সত্তা। যেন দ্রষ্টার আসন ধরে কে নাড়াচ্ছে কিম্বা যেন কেউ দ্রষ্টার সামনে কয়লার উনুনে আঁচ ধরিয়ে চারদিকে ধোঁয়া ধোঁয়া করে তুলছে --- আমার আবেগ। আবেগেরও একটা ইতিহাস আছে। তারও একটা ফাইল আছে। সে কি পরিবেশে বড় হয়েছে, তার শিক্ষার মান কিরূপ (অবশ্যই আমি কাগজে ছাপা সংখ্যারাজির কথা বলছি না, যা নাকি মেধার মান নির্ণয় করে, আমি বিশ্বাস করি না)। আরো কিছু গভীর রহস্য নিশ্চই আছে যা আবেগের উৎসকে ঢেকে রেখেছে আজও আমাদের কাছে। ধর্ম বলেছে ‘পাপের’ কথা। বিজ্ঞান বলছে অপরাধের কথা। ধর্ম পাপের সংজ্ঞা নিয়ে নিশ্চিত, বিজ্ঞান অপরাধের সংজ্ঞা নিয়ে সংশয়ে। যত দিন যাচ্ছে, মনস্তত্ত্বের যত জটিল তন্ত্রী চোখে পড়ছে তত অপরাধের সংজ্ঞা নিয়ে আমরা বদলে বদলে যাচ্ছি, অবশ্যই যা কাম্যও।
        দুটো উদাহরণ দেওয়া গেল। এবার তৃতীয় উদাহরণে আসা যাক। ঘটনা আর প্রক্রিয়া – এই দুটোই একে অন্যের সাথে জড়ামড়ি করে থাকলেও, প্রক্রিয়া বহুক্ষেত্রে ঘটনাকে ছাড়িয়ে যায়। বৃষ্টি পড়ছে – এটা ঘটনা। কি করে পড়ছে? এর উত্তর বাইরে নেই, ভিতরে এসো। আপেল পড়ার ঘটনাটা যেমন বাইরের কিন্তু মাধ্যাকর্ষণের ব্যাখ্যাটা তো বাইরের নয়। যদি বলি তা শুধু নিউটনবাবাজীর নিউরোনের মধ্যে ঘুমাতেছিল, আপেল পড়ার অভিঘাতে জেগে উঠে একটা প্রবচন দিল – যা কিনা বিশ্বশুদ্ধ লোক মাথায় করে নিল... ব্যাপারটা তাই কি? নয় ত। নিউটনের মাথার মধ্যে যে সত্যটা ধরা দিল, তা তো বিশ্বজনীন, চিরকালীন সত্য। তবে সে সত্যের মধ্যে নিউটন ছিলেন, না নিউটনের মধ্যে সে সত্য ছিল বলো তো?
        আমাদের মধ্যে কোনো সত্য থাকে না। যদি থাকত তবে তা ব্যক্তিগত হত। সার্বজনীন হত কি? খুব অহংকারী ব্যক্তি যেমন ভাবে – এ বিশ্বে যা কিছু ঘটছে, তা তাকে কেন্দ্র করেই ঘটছে। সে মনে-প্রাণে সে কথা বিশ্বাস করে বলেই যে না হাতে–কোমরে তাবিজ জড়িয়ে গ্রহ নক্ষত্রের গতিবিধি পাল্টে ফেলতে চায়! কি স্পর্ধা তার না? তাই তো একদেশের জ্যোতিষীদের সাথে অন্যদেশের জ্যোতিষীদের না মিলল গ্রহ-নক্ষত্রের সংখ্যায়, আর না মিলল বৃষ্টি-ঝড়-ভূমিকম্পের হিসাবের। কিন্তু দেখো, এক দেশের জ্যোতির্বিজ্ঞানীর সাথে সব দেশের জ্যোতির্বিজ্ঞানীর কেমন মিল। কারণ তারা যে সত্যের মধ্যে বাস করছে সে সত্যকে আবিষ্কার করছে, না তো নিজের মধ্যে নিজের মত করে সত্যকে সৃষ্টি করেছে। বাড়ির দশটা লোকের চোখে কাপড় পরিয়ে নিজেকে কন্দর্পকান্তি বিশ্বাস করানো যায়। কিন্তু সারা বিশ্বের লোকের তো চোখে কাপড় দেওয়া যায় না। ঠিক সেরকম নিজের বুদ্ধি-বোধের চোখে কাপড় বেঁধে নিজেকে নিয়ে মূর্খের স্বর্গে দিন কাটানো যায় কিছুকাল, সবার চোখকে তো ফাঁকি দেওয়া যুগ যুগ ধরে সম্ভব নয়!
        ঘটনা ছাড়াও আমরা যে শৃঙ্খলে প্রকৃতির মধ্যে আবদ্ধ, তা হল সত্যি অর্থে ধর্ম। যে অর্থে আমরা বলি, জলের ধর্ম, মানে জলের 'রিলিজয়ন' না কিন্তু। রিলিজিয়ন না, ধর্ম। একটা নিয়ম। প্রক্রিয়ার নিয়ম। মেন্ডেল নামে যে বিজ্ঞানীর কথা আমরা স্কুলে পড়েছি, সেই ধর্মযাজক মহাশয় মটরগাছের এত বর্ণ, এত প্রকার নিয়ে কি ধাঁধাতেই না পড়েছিলেন। কাটিয়ে বেরোলেনও তো। বংশগতিবিদ্যার জনক হলেন। যদিও সেদিন তার কথা কেউ আমল দেয়নি, মাথা খারাপ, উন্মাদ ভেবেছিল। তিনি গভীর বিষাদেই হয়ত বা জীবনটা শেষ করলেন। কিন্তু সেই সত্যটা কি অস্বীকৃত রইল আজ? না তো। সেদিন যদি তিনি তার ভিতরের সেই তৃষ্ণাকে, কৌতুহলকে দমিত করে, যাজক-পরম্পরার রীতি-রেওয়াজে জীবন কাটাতেন, কি সমূহ ক্ষতি হত! আবিষ্কার হত না, তা বলছি না, আরো কয়েক শতক দেরি হয়ে যেত না?
        এই শেষ ধারার পর্যবেক্ষণকেই ভারত তার প্রাচীন দর্শনে নাম দিয়েছিল, তত্ত্বালোচনা। খুব সুন্দর একটা কথা প্রচলিত ছিল – তত্ত্বদর্শী। অর্থাৎ যা দেখার অগম্য বলে জানি, তাকেও দেখার একটা উপায় আছে। যে মানুষটা স্টেশানে পিঁপড়ে দেখছিল, যে সমস্যার গভীরে ডুবছিল, তাদের ছাড়িয়েও এমন একজন তো থাকতেই পারে, যে সংসারের ঘটনাগুলো ছাপিয়ে তার মধ্যের কোনো একটা প্রক্রিয়ার সূত্র বুঝতে চেষ্টা করছে। কিছু একটা মিলিয়ে নিতে চাইছে।
        এই শব্দটাতেই থামতে চাইছি। ‘মিলিয়ে নেওয়া’। ইংরাজিতে invention আর discovery বলে দুটো পৃথক শব্দ আছে (আমাদের পৃথক শব্দ থাকলেও, যেমন ‘উদ্ভাবন’, আমরা দুটোকেই ‘আবিষ্কার’ বলে চালাই। প্রথম স্টীম ইঞ্জিন ‘আবিষ্কার’ করেন কে? আর নিউটন কি সূত্র ‘আবিষ্কার’ করেছিলেন?)। যে কোনো discovery হল কোনো একটা প্রতিবেশী সত্যকে চেনা, যে সত্যের সাথে আমার অস্তিত্বের সত্য প্রত্যক্ষ কিম্বা পরোক্ষভাবে জড়িত। তাকে নিজের বোধের সাথে মিলিয়ে নেওয়া। সে পূর্বস্থিত, অনাদি বোধ স্কিমাও নয়, অভিজ্ঞতাও নয়। সে যে কি, সে ইম্যানুয়েল মহাশয় যতদূর যুক্তি যেতে পারে, ততদূর তার অন্বেষণ করে দেখিয়েছেন – সে অগম্য, কিন্তু অনস্তিত্ব নয়। মানুষের পরম সার্থকতা সেই বোধের তীরে তীরে হাঁটা। এর অন্যথা যখনই এসেছে মানুষ যে হিংস্রতার উদাহরণ দেখিয়েছে তা শিউরে ওঠার মত। আমরা এই সময়ে, প্রায় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষপটের মধ্যে হেঁটেও যে যুদ্ধকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি না, তার কারণ প্রাক্তন দুটো বিশ্বযুদ্ধ। আমাদের স্মৃতিপথে তারা এখনও ম্লান হয়ে যায়নি যে!
        সেই বোধের গভীরে যাওয়াকেই ভারত বলেছিল – অন্তর্মুখ হও, নিজেকে জানো। এই ‘নিজে’ অর্থে একটা ব্যক্তিসত্ত্বাকে বোঝাতে চেয়েছিলেন মাত্র, এতটা স্বল্পদর্শী তারা ছিলেন বলে বিশ্বাস হয় না। তবে প্রকৃতির সাথে অমন মিলেমিশে থাকার কথার সাক্ষ্য আমাদের প্রাচীন সাহিত্য বহন করত না। তাও-সম্প্রদায়ের মতে, জীবনে চলার মূলসূত্রই হল, প্রকৃতির মত সহনশীল হও। নমনীয় হও জলের মত। যা কিছু মৃত তাই কঠিন, তাওবিদ বলছেন, দেখোনি মৃত উদ্ভিদের দেহ, মৃত প্রাণীর দেহ? কেমন কঠিন, কেমন অনমনীয়? প্রকৃতির সাথে চলার ছন্দটা আবার খুঁজে নাও। গভীরে পর্যবেক্ষণ করো। কোনো ঘটনা না। কোনো দুঃখ-সুখ না। প্রশ্ন করো, কোন সূত্রে এত বৈচিত্র একছন্দে গাঁথা পড়ে আছে–

“নৃত্যের বশে সুন্দর হল বিদ্রোহী পরমাণু,
পদযুগ ঘিরে জ্যোতিমঞ্জীরে বাজিল চন্দ্র ভানু।
     তব নৃত্যের প্রাণবেদনায়     বিবশ বিশ্ব জাগে চেতনায়
     যুগে যুগে কালে কালে     সুরে সুরে তালে তালে,...”

তোমার গভীর দেখাই তোমার খোঁজা। তোমার খোঁজাই তোমার সাধনা। তোমার সাধনাই তোমার করুণার গঙ্গোত্রী।

“হেথায় কারো ঠাঁই হবে না    মনে ছিল এই ভাবনা,
          দুয়ার ভেঙে সবাই জুটেছে।
যতন করে আপনাকে যে     রেখেছিলেম ধুয়ে মেজে,
          আনন্দে সে ধুলায় লুটেছে ॥”