সৌরভ ভট্টাচার্য
9 November 2014
ছোটবেলায় আমার সাথে সাথে ফিরত আমার শৈশব। তার সাথে তার বায়না। সব কিছুই তার খেলার জিনিস। ইচ্ছা হলেই পাওয়ার জিনিস। যোগ্যতা শব্দটা তখন তার অভিধানের বাইরে।
বড়দের শাসন, "উঁহু, এরকম করতে নেই", "চাইতে নেই" - গোছের বাক্যগুলোই তখন না-পেতে পাওয়ার একমাত্র বাধা। কেন পেতে নেই, এটা বোঝার, বা তলিয়ে ভাবার থেকে ওটা বড়দের না-দেওয়ার অজুহাত ভাবাটাই স্বাভাবিক তখন। কারণ ওই যে বললাম, যোগ্যতা বলে কিছু হতে পারে এতো তার বোধের বাইরে।
এই স্বভাবটা যখন শৈশব অবধি থাকে তখন সমস্যা নেই। সমস্যা হয় যখন বড় হওয়ার সাথে সাথেও এই 'চাইলেই পেতে পারি' অভ্যাসটা থেকেই যায়। ছোট বয়সে যাকে 'বায়না' বলি, বড় বয়সে সেটাই 'বাসনা'। কিন্তু বাসনা আর বায়নার মুল তফাৎ হল প্রথমটায় যোগ্যতার জ্ঞানটা থাকা যতটা জরুরী, দ্বিতীয়টায় তার প্রশ্নই ওঠেনা। কোনো শিশুর যোগ্যতা অনুযায়ী বায়নার কথা ভাবা, ভাবনারও অতীত। এমনকি মহাপুরুষদের শৈশবের আচরণেও এর ব্যতিক্রম নেই। কিন্তু উল্টোটা যদি হয়, অর্থাৎ বাসনাটা যদি বায়নার স্বভাব নেয়? সে যদি না ভাবে এটা পাওয়ার বা পেয়ে রাখতে পারার যোগ্যতা আমার আছে কি না?
তখন তার নিজের অশান্তি, তাকে ঘিরে থাকা মানুষদেরও অশান্তি। আর সমস্যা হচ্ছে সংসারে কিছু কিছু বোধ আছে যা নিজে থেকে তৈরী না হলে তাকে বাইরে থেকে আনা অসম্ভব। যেমন খেতে বসে কারোর স্বাভাবিকভাবে কতটা খেতে পারি, এ বোধ যদি না থাকে, তবে তা তার নিজের স্বাস্থ্যের পক্ষে কি প্রবল হানিকর সে বলা বাহুল্য।
অনেকের মধ্যে অতিরিক্ত পজিটিভিজম এই বিপত্তিটাকে আরো আস্কারা দিয়ে কোথায় পৌঁছে দেয় তাও দেখেছি। কোথাও যে থামতে হবে, বা থামাটা দরকার এ যেন সে বিশ্বাসই করে উঠতে পারে না। তার শুধু মনে হয় সেটা তার ভবিষ্যতের উজ্জ্বল সম্ভাবনার পক্ষে নিদারুন হানিকর চিন্তা। ফলে সে ছুটতেই থাকে ছুটতেই থাকে। তার জুতো ছিঁড়ে যায়, জামা-কাপড় ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়, পায়ে ফোস্কা পড়ে, ঘুম ছুটে যায়, তবু সে ছুটেই যায়, ছুটেই যায়। তার বন্ধু-বান্ধবদের হাত ছেড়ে যায়, পরিবারের নাগাল পেরিয়ে যায়, তবু তার ছোটা আর শেষ হয় না। আর পাশে কিছু লোক, কিছু মিডিয়া-প্রদীপের ভুত- "আরো জোরে... আরো জোরে..." বলে চীৎকার করতেই থাকে তার ঘিলুর পাশে, চোখের পাশে, কানের কাছে। সে দৌড়েই যায়, দৌড়েই যায়। অবশেষে প্রকৃতির নিয়মেই হঠাৎ পড়ে যায় মাঝ রাস্তায় মুখ থুবড়ে। মিডিয়ার ভুত আর অত্যুৎসাহীর দল আরেকজনকে খুঁজে নেয়।
সে ক্ষত-বিক্ষত শরীরে রাস্তার ধারে নিঃসঙ্গতায় সেই ছুটন্ত মানুষগুলোর দিকে লোভার্ত, ঈর্ষান্বিত, পীড়িত চোখে তাকিয়ে থাকে। তার নিঃসঙ্গতা আর কাটতেই চায় না। কারণ মানুষের সঙ্গে থাকার অভ্যাসটাই তার হারিয়ে গেছে। বা হয়তো কদাচিৎ তার মনে হয়, "এতটার কি সত্যিই দরকার ছিল!"
কিন্তু ততদিনে তার জীবনে অনেকগুলো বসন্ত পার হয়ে গেছে! তার ফেরার পথ আর এগোবার পথ দুই-ই সপাটে বন্ধ হয়েছে মুখের ওপর। তার মনে হয়, যদি পুরোটাই স্বপ্ন হত! কিন্তু দুঃস্বপ্ন না সুস্বপ্ন সেটাও সে ভাল করে বুঝে উঠতে পারে না। কি উন্নতি!