Skip to main content

mini

রাস্তাটা কালকেই ঝাঁট দিয়েছে। আজ আর এদিকে আসিস না। যা যা ওদিক দিয়ে হাঁট।

কথাটা বলতে বলতে মিনি হাঁটছে। মিনি এ পাড়া, সে পাড়া দিয়ে যেতে যেতে সব ক'টা কুকুরকে বলে, যা যা, ঘরে যা। ঘুরিস না এদিক ওদিক।

মিনি জানে সব কুকুরের নিজস্ব ঘর আছে। ঘর নেই শুধু তার। তার প্ল্যাটফর্ম আছে। সেখানেও অনেক কুকুর। তাদেরও মিনি বাড়ি যেতে বলে। নইলে লাইনে কাটা পড়বে। যেমন পড়েছে অনেকে। লাইনে কাটা পড়লে মিনির অসহ্য লাগে। কারণ ডাকলে আর সাড়া দেয় না।

কেউ সাড়া না দিলে মিনির অসহ্য লাগে। তার বাবাকে দেখেনি। মাকে অনেক ডেকেও যখন সাড়া পায়নি, যখন ভোরের প্রথম কল্যাণী লোকালটা খবরের কাগজের ডাঁই নিয়ে এসে দাঁড়ালো, যখন মিনির দিকে না তাকিয়ে ট্রেনটা চলেও গেল, মিনির অসহ্য লেগেছিল। মাকে অনেক বেলায় অনেকে নিয়ে গেল সামনের হাসপাতালে। ডাক্তার বলল, পুড়িয়ে দিতে। ওরা নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দিল। মিনিকে কেউ কেউ মিষ্টি খেতে টাকা দিল। মিনি কয়েকদিন মিষ্টির দোকানে কচুরি আর মিষ্টি খেয়েছে পর পর। বমি করেছে। পায়খানা করেছে। তারপর টাকা ফুরিয়েছে। মা ফুরিয়েছে। কদিনের খিদের সুখ ফুরিয়েছে।

মিনি কুকুরদের বাড়ি যেতে বলে, একটু আগেই বললাম না, কারণ মিনি একমাত্র কুকুরদের ভাষা বোঝে। এটা যদিও আলাদা করে বলিনি, তবু এটা ঠিক যে বিচক্ষণ পাঠক এতক্ষণে বুঝে গেছেন, মিনি পাগল। আর মিনি কুকুরের ভাষা বোঝে।

আমিও একটা সময় অনেকের মত বিশ্বাস করতাম, আমি কুকুর মানে কি জানি, পাগল মানে কি জানি, ভিখারি মানে কি জানি। আমি নিজেকে সুস্থ, দায়িত্বশীল, কর্তব্যপরায়ণ মানুষ হিসাবে বিশ্বাস করতাম। নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করতাম।

এর মধ্যে অনেক কিছু বদলে যেতে লাগল। খবরের কাগজে মানুষের গল্প বেরোয় বেশি। আমি প্রতিদিন বদলে যাওয়া মানুষের পৃথিবীর ছবি দেখছি। কিভাবে নিজের ভাইবোনের গলা কাটছে মানুষ। অত্যাধুনিক সব অস্ত্রশস্ত্র কি নিপুণ দক্ষতায় হত্যালীলা চালিয়ে যাচ্ছে। আমি প্ল্যাটফর্মে বসে বসে খবরের কাগজ পড়ি, আর মিনির দিকে তাকাই। দেখি মিনি সবক'টা কুকুরকে সাবধান করছে। পাগল কে?

আবার আমি আমার দিকে তাকাই। আমার সূক্ষ্ম, তীক্ষ্ম বুদ্ধির দিকে তাকাই। (আত্মস্তুতি গাইছি না নিজের বুদ্ধি নিয়ে। অন্তত যা আমাদের বিশ্বাস করানো হয় নানা অঙ্কের মার্কশিট দিয়ে তাই বলছি। সে অর্থে তো আমি বুদ্ধিমান)। কিন্তু সে বুদ্ধির গোড়া খুঁজতে গিয়ে হতাশ হই। কিছু মুখস্থ শব্দ, সংখ্যা আর স্বার্থ চরিতার্থ করার ছল ছাড়া তার কোনো উপজীব্য নেই। আমি হতাশ হয়ে মিনির দিকে তাকাই। এক পাতাঝরা বসন্তের বিকেলের উপলব্ধি নিয়ে তাকাই। আমি জানি এ হত্যালীলা স্তব্ধ করা, বুদ্ধির অগম্য। কারণ উন্মত্ত জলরাশিকে থামাতে আরেকটা উন্মত্ত জলরাশি লাগে না, লাগে বাঁধ। বন্যার প্লাবনকে ঠেকায় বাঁধ।

সে বাঁধ কই? যে বাঁধ রাস্তায় নেমে আসবে রাজ সিংহাসন ছেড়ে, অঙ্গুরিমালকে বলবে, থামো। যে বাঁধ বলবে, ওরা কি করছে ওরা জানে না। যে বাঁধ মানুষের কল্যাণের রাস্তা খুঁড়তে খুঁড়তে হাতে হেমলক নিয়ে দাঁড়ায়। যে বাঁধ পাত্রের আঘাতে ঝরা মাথার রক্ত মুছে বলবে, তবু ঘৃণা থামা। যে বাঁধ নোয়াখালির রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বলে, শান্ত হও, যে অনশনে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে, কুঁকড়ে যাওয়া শরীরকে বলে, আরেকটু, ওরা শান্ত হবে, আমার বিশ্বাস মানুষের বিবেকের কাছে, আছে।

আমাদের বাঁধ নেই। আমাদের পরিসংখ্যান আছে। প্রমাণ আছে। আর সেই অনুপানে বাঁচা সভ্য সমাজের দুলালি বুদ্ধি আছে। তার সব আছে। শুধু পাগলামিটুকু নেই। যে পাগলামিতে আরেক পাগলামিকে থামানো যায়। বাঁধের মত।

আসলে বিশ্বজোড়া শপিংমল বানিয়েছি। বিজ্ঞানের এক এক পরতের আবিষ্কার, শপিংমলের এক এক তলা তৈরি করছে। মায়ের উঠানের মত, মায়ের রান্নাঘরের মত, মায়ের শোওয়ার ঘর, বসার ঘরের মত পৃথিবীটা ভাবতে পারিনি তো। ওকি আমাদের এই মার্কশিটে বাঁচা, সার্টিফিকেটে বাঁচা বুদ্ধির কম্ম?

বরফে হাত রাখলে যেমন বুঝি ঠাণ্ডা, গরম ভাতের মধ্যে হাত ডোবালে যেমন বুঝি গরম, তেমন যুক্তিবুদ্ধি ছাড়াই বুঝি কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল। বোঝাতে না পারলেও বুঝি। যেমন দুদিনের খিদের কষ্ট ভাষার অগম্য, তেমনই।

কিন্তু সে পাগল কই? যে মিনির মত রাস্তার কুকুরদের হাতে করে পার করিয়ে দেবে রাস্তা? নিজের আধপেটা খাবারকে ভাগ করে নেবে ওদের সঙ্গে?

তবে কি আমি প্রতিবাদ করছি না? তবে কি কেউ সেই যুদ্ধের, হিংসার পরিসংখ্যান রাখছে না? সব হচ্ছে।

এতটা এসে পাঠক নিশ্চয় আমার মত নিশ্চিত হয়ে গেছেন। তবে তো যে সব মানুষদের কম্ম সে আমি নই।

কিন্তু ভাবো, আগামীকাল কি বার? একুশে ফেবরুয়ারি। কারা ছিল তারা? কোন দৈবী ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ? সাধারণ তোমার আমার মত তারা। কিন্তু তারা বাঁধ হতে পেরেছিল। বুদ্ধির পরিসংখ্যান আর শব্দের হাজার সতর্ক বার্তা উপেক্ষা করেছিল তো তারা? যে ভাষাটাকে প্রতিদিন অপদস্থ করছি তার জন্যেই তো?

যে ধর্ষক ভুলে যায় যে, ধর্ষক হয়ে জন্ম নিতে গেলেও ওই একই রাস্তা দিয়েই আসতে হয়, যেখানে রড থেকে শুরু করে না জানি আর কি কি ঢোকাবার সাধ হয় তার, সে ধর্ষককে আমি তত ভয় পাই না, যে ভয় পাই আমি পরিসংখ্যান আর শব্দের উজ্জ্বলতায় যারা সভ্য সমাজকে বলে, ভুলে যাও, অন্যদিকে তাকাও। তাকে দেখলে আমার হাড় হিম হয়ে আসে ভয়ে।

ভয় হয় এই বিশাল জনতাকে পরিসংখ্যান আর শব্দ দিয়ে ভুলিয়ে দেওয়া যায়, এই জন্যে। ভরসা এই যে, এই বিশাল জনতা জেগে উঠলে পরিসংখ্যান আর শব্দের সামন্ততন্ত্র ছেড়ে ফোঁস করে জেগে ওঠে বলে। তখন সে বোঝে হৃদয় একটা অনুভব। অনুভব একটা বিশ্বাস। বিশ্বাস একটা প্রেরণা। যে প্রেরণায় বাঁধ হওয়া যায়। উন্মত্ত বন্যাকে ঠেকাতে আরেকটা বন্যা হতে হয় না, বাঁধ হতে হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি এই কথাটাই আবার জানিয়ে গিয়েছিল, সেই ভাষাটার জন্য, যে ভাষাতে মিনি সব কুকুরকে সাবধান করে, আর যে ভাষাকে অপদস্থ করছি প্রতিদিন আমরা, লোভের সামন্তবাদকে যুক্তি আর পরিসংখ্যানের বরমাল্য পরিয়ে।

 

(ছবিটা সদ্য Netflix এ আসা আইনস্টাইন সিনেমার শুরুর দৃশ্য। আইনস্টাইনের ঘরের টেবিল। সিনেমাটা গোটা দেখা হয়নি, তাই জানি না কেমন হয়েছে আগেভাগেই বলে রাখলাম।)