হিন্দু মহাসভা নাথুরাম গড্সের মন্দির প্রতিষ্ঠা করল। নাথুরাম গড্সে তাদের আদর্শ, পুজ্য। তার কারণ তিনি হিন্দুধর্মের মহত্ব প্রচার করেছিলেন বলে নয়, গান্ধীকে হত্যা করেছিলেন বলে। গান্ধীকে ও তার আদর্শকে কারোর অপছন্দ হতেই পারে, সভ্যতার ইতিহাসে গড্সে ও মহাত্মার অবদানের ফারাক বোঝার মত মানসিকতা বা ইচ্ছা অনেকের না-ই থাকতে পারে। কিন্তু পৌরাণিক পুরুষ রাম তথা কৃষ্ণ পূজ্য কি শুধু রাবণ তথা কংস নিধনের জন্য, না ধর্মসংস্থাপনের জন্য? ধর্ম অর্থে আমি একটা সামাজিক ব্যবস্থাপনার কথা বলছি। পূজ্য হতে গেলে কি কারোর হত্যাকারী হওয়াই যথেষ্ট?
স্বভাবতই এ প্রশ্ন আমি হিন্দু মহাসভার কাছে রাখছি না। কারণ, ধর্মের যে দিকটা প্রাতিষ্ঠানিক তথা ঐতিহাসিক তা কোন না কোনভাবে অচলায়তন হয়েই দাঁড়ায়। আর পশ্চাৎগমনের মধ্যেই সমস্ত গৌরব, প্রাচীনত্বই ঐতিহ্য, যা কিছু পুরোনো তাই পবিত্র, নির্ভুল, ধ্রুব --- এমন বিশ্বাস পোষণকারীর দল পৃথিবীর সব ধর্মেই আছে। পাশ্চাত্য সভ্যতা তার উন্নয়নের পথে এগিয়েছে ধর্মকে উন্নত করে নয়, নিজেকে ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন করে। একাজ বহু আগে কান্ট, স্পিনোজা, সর্বোপরি ভোল্টায়ার দিয়ে শুরু হয়েছিল, যদিও গ্রীসে এ মুক্তচিন্তার আরোও প্রাচীন উদাহরণ পাওয়া যায়।
একটা সদ্যঘটিত উদাহরণ নেওয়া যাক। একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ধর্মগুরুর, যিনি জীবনে বেঁচে থাকার শিল্পকলা শেখান (Art Of Living), তিনি সমকামিতাকে একটি ব্যাধির আখ্যা দিয়েছেন। তার কয়েকদিনের মধ্যেই আজ অস্ট্রেলিয়ায় সমকামিতার স্বীকৃতির মহোৎসব পালিত হচ্ছে। তবে কি সমকামিতাকে স্বীকৃতি দিলেই মুক্তমনা হওয়া যায়? অবশ্যই না। এটি একটি উদাহরণমাত্র, যা প্রাচীন সংস্কারকে ভেঙে নতুন পথের দিকে নির্দ্বিধায় পা বাড়াতে পারে। একসময় কন্ডোমের ব্যবহার এবং গর্ভপাত নিয়ে খ্রীষ্টিয় মিশনারীদের সাথে প্রগতিশীল সমাজের বিরোধ ঘটেছিল। স্বভাবতই কেউ কাউকে বুঝিয়ে উঠতে পারেননি কোনটা কেন বেশি জরুরী এবং কেন নয়। অবশেষে সমাজ অর্থাৎ প্রগতিশীল সমাজ নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে সভ্যতার এগিয়ে চলার পথ পরিস্কার করে। আজ ভারতের সে দিন এসেছে। ভয় গেরুয়ায় নয়, ভয় প্রাচীনত্বের মোহে।
বার্ট্রান্ড রাসেল একবার বলেছিলেন, বেথোভেন, বাক্ যদি নিশ্চুপ থাকতেন, কিম্বা শেক্সপীয়র, বায়রন যদি কলম না ধরতেন, তবুও সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কোন প্রভাব পড়ত কি? পড়ত না। কিন্তু বিজ্ঞানের অগ্রগতি থেমে থাকলে আজ সাধারণ মানুষের জীবন অনেকটা পিছিয়ে আটকে থাকত, অথবা শ্লথগতিতে এগোত --- এ বলার অপেক্ষা রাখে না। একবার আমার প্রবল জ্বরে আমার সমীপবর্তী বন্ধুকে ঠাট্টা করে বলেছিলাম, “প্যারাসিটামলের থেকে প্রয়োজনীয় বস্তু সংসারে এই মুহূর্তে আর দেখছি না কিছু। ঋষিবাক্য মাথায় থাকুন, আত্মা যতই অবিনশ্বর হোন, আমায় একখানি প্যারাসিটামল ৬৫০ দে বাবা।”
তবে কি বিজ্ঞানের অগ্রগতি সবক্ষেত্রে খুব আশাব্যঞ্জক? অবশ্যই না। সত্যজিৎবাবুর ‘আগন্তুক’ এবং রবীন্দ্রনাথের ‘সভ্যতার সংকট’ যেন দুই প্রবল চিন্তাবিদের দুটি উপসংহার, যা একই সূত্রে প্রতিষ্ঠিত। ভবিষ্যৎটা তবে কার হাতে?
আত্মার অবিনশ্বরতা না মানলেও সমাজের অবিনশ্বরতা স্বীকার করি। সমাজ একটা প্রবহমান নদী, যার কিছু জল বাস্পীভূত, শোষিত, অপসারিত হলেও নদীর আকার আকৃতি একই থাকে। সমাজও তেমনি। কোথাও কোথাও কেউ কেউ নদীর অববাহিকায় গর্ত কেটে, কিম্বা নদীর পাশে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ তৈরী করে, সেই আপন কীর্তির মোহে তাকেই নদী আখ্যা দেবে এ বিচিত্র কিছু না। তাদের সাথে বিবাদ করতে যাওয়া বৃথা। ঈশ্বরও শুদ্ধহৃদয়ের অভাবে শয়তানে পরিণত হন এ উদাহরণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং অগণিত রক্তপ্লাবিত ধর্মযুদ্ধ। আর শুদ্ধতাটা অনুভবের বিষয়, তর্কের নয়। কিন্তু অভিশপ্ত প্রাচ্যের এই ইতিহাসের পুণরাবৃত্তি যেন শেষই হতে চায় না। বুদ্ধিতে স্বীকার করলেও প্রাণে তাকে সঠিকভাবে অনুভব করার অভাবে, ‘প্রগতি’ শব্দটা মুখেই উচ্চারিত হয়ে থাকে, অন্যদিকে আচরণে সেই সংস্কারলব্ধ পথকেই মূল জেনে আত্মতুষ্টিতে ভোগা ছাড়া কোন বিকল্প থাকে না।
অবশেষে বলি, এ কোন হিন্দু ধর্মসভা? কারণ হিন্দু না তো দলবদ্ধ, না তো সংঘবদ্ধ, না তো তন্ত্রবদ্ধ কোন বিশেষ দল --- একথা বহু আলোচিত। সে আত্মায় বিশ্বাস করে, বেদান্তে বিশ্বাস করে, গুরুতে বিশ্বাস করে, পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে। বাকি অন্য কোনো আদর্শ তার পক্ষে মেনে চলা বাধ্যতামূলক নয়। সে ঈশ্বরকেও অস্বীকার করতে পারে।
আজ মানুষের জীবন ততটা অন্তর্মুখ নয় যতটা আগে ছিল, বা সম্ভব ছিল। অন্তর্মুখ ধর্ম যে আত্মবিশ্লেষণ তথা চিত্তের ঔদার্যের বৃদ্ধির অনুশীলন শেখায়, বহির্মুখ ধর্ম ততটাই ভয়ঙ্কর হয়ে দল পাকিয়ে ‘Holier Than Thou’ হতে শেখায়। তাই যে ভারতবর্ষ আদি শঙ্করাচার্যের ‘বিবেকচূড়ামণি’তে জাতপাত, উচুনীচু, ধর্ম-অধর্ম ত্যাগ করার উচ্চদর্শনের কথা বলে, সেই-ই ‘মনুসংহিতা’তে এসে মানুষে মানুষে বিভেদ টানার কথা শেখায়, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। ঐ যে বললুম ধর্ম অন্তর্মুখ হলে যে উদারতা শেখায় বহির্মুখ হলে ততটাই গন্ডী কেটে নিজের স্বকল্পিত মহত্বে অন্ধ হয়।
সব গৌরবময় অধ্যায়ের একটা শেষ থাকে। আমাদেরও ছিল। কিন্তু সেই ‘ছিল’টাকেই যদি আজ মুখ্য করে তুলি, তবে চলা দায় হয়। মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্বল তার মনুষ্যত্ব। যার মূলমন্ত্র ‘তুমি’ আর ‘আমি’ প্রতিভায়, ক্ষমতায় ভিন্ন হলেও বেচে থাকার অধিকারে ও সন্মানে এক। একাধিপত্যের জন্য এ সংসার নয়, ইতিহাস সাক্ষী। সংসার ‘এক’-এর বলে চলে না, একত্বের বলে চলে, তাকেই প্রগতি বলে।