বিন্দু বিন্দু মনের গুঁড়ো ছড়াচ্ছে সারাটা দিন জুড়ে। জড়ো করতে গেলে খেলনার মত রূপ। যার মানে নেই। একটা গাছের শুকনো ডাল, দূর থেকে ভেসে আসা মানে না বোঝা কথা, বাতাসের হাল্কা গা ছুঁয়ে যাওয়া - এ সবারই কোনো ব্যাখা নেই।
বুদ্ধি বুদ্ধু এখন। অনুভব তার সমস্ত সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে টহল দিচ্ছে চারপাশ। প্রতিক্ষণে তার অস্তিত্বে জাগছে নতুন অনুরণন। শান্ত আকাশের মত তার সারা গায়ে কোমল থিরথির মেঘমালার মত সুখ। একে এক কথায় কি বলে? অবকাশ? হবেও বা।
যাই বলি না কেন, এ সময়ের মধ্যে কোথাও একটা করুণ রসের গোপন সঞ্চার থাকে। কি কথা যেন মনে এসেও মনে আসে না। ছুঁয়ে যেতে যেতে কি একটা যেন বলে যায়? সেটা কি - বিরহ? ক্ষোভ? প্রেমহীনতা? জানি না।
আচ্ছা কোনো অপূর্ণতাই বা হবে কেন? পূর্ণতার কোনো বেদনা নেই?
আছে। সে বেদনার সুর অন্যরকম। তার ভাব পূর্ণ বিকশিত ফুলের, তবু কিসের একটা বেদনা। পূর্ণতার বুকের মধ্যে একটা অপূর্ণতার ব্যাথা থাকে। সেটা কি?
সেটা আত্মসমর্পণের আকুতি। নিজেকে পূর্ণ করে পাওয়াই কি শেষ কথা? না। পূর্ণ করে পাওয়ার পর আসে পূর্ণভাবে লীন হতে চাওয়ার ব্যাকুলতা। কিন্তু সে ব্যাকুলতা কার প্রতি? কার কাছে সে চায় পূর্ণ বিলীনতা?
অসীমের প্রতি। যে অসীম অজ্ঞেয়। যে অসীম দুরূহ তার অসীমতায়। তাকে জানার দ্বারা সীমায়িত করা জানা যায় না। পাওয়ার দ্বারা সীমায়িত করা যায় না। অনুভবের দ্বারা রঞ্জিত করা যায় না। কাল যাকে খণ্ডিত করতে পারে না আপন নিগড়ে। সেই অসীমের প্রতি। তাতে সব পূর্ণতার চরম পরিণতি। সব সার্থকতা তার মধ্যে চরম আত্মবিসর্জনে। তা কি মৃত্যু?
না। মৃত্যু একটা যাত্রাপথের বাঁক মাত্র। তার চরম পরিণতি কিছুতেই নয়। তাই তাকে বারবার ফিরে ফিরে নিজেকে গড়তে হয়। আবার ভাঙতে হয়। ফের গড়তে হয়। এই ভাঙাগড়ার চক্রের মাধ্যমে সে পূর্ণতার দিকে এগোয়। পূর্ণতা শুধু ভাঙাও না, শুধু গড়াও না। এ দুই ধারাকে নিয়েই তার অস্তিত্ব।
সেই পূর্ণতার ব্যাথা যতক্ষণ না বুকে বাজছে, যতক্ষণ না দু'হাত উপুড় করার তাগিদ দিনরাতের স্থবির সুখকে পীড়িত করছে - ততক্ষণ নিস্তার নেই। কোনো পূর্ণতাই ততক্ষণ সেই চরমের সুখ পায়নি বুঝতে হবে, যতক্ষণ না সে নিজেকে নিঃস্ব করতে চাইবে স্বেচ্ছায়। বিলীন হতে চাইবে আনন্দে, সেই পরমানন্দে। যা অসীম। যা সব মাধুর্যের পরাকাষ্ঠা। যেখানে, সব শেষের শুরু আবার সব শুরুর শেষ।
উপনিষদ যাঁকে বলেন -
ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে।
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।।
ব্রক্ষ্ম অনন্ত। এই জগৎও অনন্ত। কিন্তু 'এই' জগৎ 'সেই' ব্রক্ষ্মের উপর আরোপিত সত্তা মাত্র। 'এই' জগৎকে যদি সরিয়ে দেওয়া যায় (তথাপি) 'সেই' ব্রক্ষ্ম অনন্তই থাকেন। ওঁ শান্তি, শান্তি, শান্তি।