বিষের কাজ শুরু হল। মারা যেতে যেতে সে জিজ্ঞাসা করল, আমায় বললে না কেন তুমি আমায় বিষ দিচ্ছ?
ভালোবাসার মানুষ বলল, শুনে যদি কষ্ট পাও, তাই বলতে পারিনি।
এটা গপ্পো? গপ্পো বটে, আবার না-ও বটে।
মানুষ অ্যাডভ্যান্টেজ নেবেই। যত দেবে তত নেবে। এ স্বাভাবিক। শরীর, মন, সুযোগ-সুবিধা, অর্থ --- যা দেবে বিকিয়ে, তা-ই নিয়ে নেবে। হ্যাঁ, সব বিকিয়ে দিয়ে হাহুতাশ করে তো লাভ নেই। তবে ওই মিষ্টি কথায় বিষই জুটবে ভাগ্যে।
ইংরাজিতে একটা কথা আছে, বর্ডারলাইন টানতে শেখা। একবার কাউকে বর্ডারলাইন পার করে ভিতরে ডেকেছ কি গেছ। বাইরে গেলে যেমন দরজায় তালা লাগিয়ে না গেলে বিপদ, তেমনই সীমারেখা না টেনে রাখলে যে কোনো সম্পর্কেই বিপদ।
একজনের স্বামী ছেড়ে গেল। পরিবার, সমাজ বলল, ধর্মে মন দাও। সে ধর্মে মন দিল। একবার নিজেকে জিজ্ঞাসাও করল না সে নিজে কি চাইছে। এদিকে দিন যত যায় ধর্মের সামাজিক গ্ল্যামার তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে। ক্রমে সে সাদা লালপেড়ে শাড়ী ছাড়া আর কিছু পরতেই চাইল না। সমাজে কি তার মান! সাধিকা!!
কিন্তু এ তো বাইরের গল্প। জোয়ার-ভাটার গল্প। কিন্তু মনের গভীরে যে সিঁড়ি, সেখানে না যাতায়াতে জমছে শ্যাওলা। রাস্তা হচ্ছে পিচ্ছিল।
ক্রমে তার বয়েস যত বাড়ল, তার আচার বাড়ল। আচার যত বাড়ল তার শুচিবাইতা তত বাড়ল। আগে যেখানে মন সবেতেই প্রসন্ন থাকত এখন মন কেমন যেন তিরিক্ষি। কিন্তু কোথা থেকে এত অসন্তোষ? কোথা থেকে এত ক্ষোভ? সে জেনেও জানতে চাইল না। এদিকে তার বাড়ি মানুষের ঢল। নানা অনুষ্ঠানে, নানা শুভকাজে তার ডাক পড়ে। সে যত যায় তত চোখে পড়ে এর-তার দোষ। রাগ হয়। আগে চেপে রাখত। এখন বলে দেয়। মানুষ রেগে যায়। দূরে যায়। সমীহ করে দূর থেকে। তবু মানুষটা খুঁজে দেখল না কেন এত ক্ষোভ তার! এখন সে বয়েসের আগেই বয়স্ক। শুচিবাই। ধার্মিক। পূজাপাঠে দিন যায়।
আমার এক এক সময় তার আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশীদের জনে জনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে, এতে কার কি লাভ হল? একটা মানুষকে এভাবে বঞ্চিত করে আদৌ সমাজের কি উন্নতি হল? মানছি সে মানুষটা আরো সবল হতে পারত, নিজের ইচ্ছাকে সজোরে ঘোষণা করতে পারত। কিন্তু সবাই কি সমাজে এত প্রবল ব্যক্তিত্ব নিয়ে জন্মায়? সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে সমাজ কি তার পাশে দাঁড়াতে পারে না? না, পারে না। মহাপুরুষ বানাবার আর মহাপুরুষ হওয়ার এক অদ্ভুত লোভ আমাদের!
আরেকটা ঘটনা। একজন পুরুষ। আরেকজন পুরুষকে ভালোবাসল। যাকে ভালোবাসল, সে যথেচ্ছভাবে তাকে ভোগ করে, সময় মত সমাজের নিয়ম মেনে একজন মেয়েকে বিয়ে করে তথাকথিত 'স্বাভাবিক' জীবনে ফিরে গেল। যে থেকে গেল, সে ক্রমে পাগল হল। তার পরিবার তাকে মনোবিদের কাছে নিয়ে গেল, তান্ত্রিকের কাছে নিয়ে গেল। কিন্তু একদিনও স্বীকার করল না যে তার সঙ্গে যা হয়েছে সেটা অন্যায়! বিশ্বাসঘাতকতার যন্ত্রণা এক, কিন্তু সে যন্ত্রণাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা আরো যন্ত্রণার, আরো অপমানের। মানসিকভাবে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে দিল সে মানুষটাকে। সে-ও ধর্মের আশ্রয় নিল। স্বস্তি চাইল ঈশ্বরের কাছে, যা মানু্ষের কাছে পাওয়ার কথা ছিল। কি পেল জানি না, আমি যখন তাকে দেখেছি, সবটা জেনেছি, সে একটা আধমরা, প্রাণহীন, আবেগ-অনুভূতিহীন রক্তহাড়মাংসের অস্তিত্ব একটা। তার সঙ্গে কথা বলে যতটা বুঝেছি তাকে পীড়া দিয়েছে তার আত্মীয়স্বজনের অস্বীকার করাটাই বেশি। তার আত্মমর্যাদাকে তছনছ করে দিয়েছে। সবাই তো আর উঠে দাঁড়াতে পারে না, অনেকেই তাই ছদ্মবেশের আড়ালে নিজেকে ক্রমে ক্রমে শেষ করে দেয়।
প্রথম কথাই হল নিজেকে জানা। নিজেকে স্বীকার করা। সাহসের সঙ্গে, আনন্দের সঙ্গে। একটা কথা তো মানতেই হবে, নিজেকে না জানলে নিজের স্রষ্টা বলে যদি কেউ থাকেন তাকে জানব কি করে? নিজেকে প্রচ্ছন্ন রেখে মিথ্যার আড়ালে কোন সত্যের খোঁজ করে চলেছি? সে তো আমার বানানো কল্প সত্য, অন্য অর্থে যা মিথ্যা।
সাহস, আত্মবল, উদ্যম --- সব কিছুর মূলেই হল নিজেকে জানা। নিজেকে সম্মান করতে শেখা। নিজেকে জানলে, নিজেকে সম্মান করতে শিখলে কোথায় কার সীমারেখা টেনে দিতে হবে সে বোধটা স্পষ্ট হয়ে যায়। সেটা কোনো বই পড়ে বা কোনো বাইরের মানুষের কাছে শেখা যায় না। নিজেকে জানতে জানতেই সে স্বাভাবিকবোধ তৈরি হয়।
এই মূল কাজটা যদি বাকি থাকে তবে আমি নিজে আর আমার প্রাপ্ত যা কিছু অন্যের অ্যাডভ্যাণ্টেজের উপাদান। তারা নেবেই। আর আমি অন্তরের দৈন্যকে ঢেকে আমার যা কিছু সব নিয়ে আর আমার আমিকে নিয়ে বাইরের ভ্যালিডেশানের বা বৈধতার ভিক্ষায় ভিক্ষাপাত্র নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে একদিন রাস্তাতেই প্রাণবায়ু ফুরিয়ে পড়ে থাকব। সে আমার ভবিতব্য হবে না, হবে আমার স্ব-আরোপিত অজ্ঞতা।