সৌরভ ভট্টাচার্য
17 June 2019
এখন চলতে ফিরতে মাঝে মাঝেই ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি শুনি। ‘রাম’ নামটা শুনলেই বাল্মীকি মহাশয়, তুলসীদাসজী, কৃত্তিবাস মহাশয় স্মৃতিতে আসে। অবশ্যই মহাত্মার শান্তস্নিগ্ধ মুখাবয়বটাও। এদের মধ্যে তুলসীদাসজীর ‘রাম’ আমার অত্যন্ত প্রিয়। তার একটা কারণ অবশ্যই অসামান্য কাব্য, মনোমুগ্ধকর ভাষা। এত সরল সহজ গ্রাম্য ভাষায় যে এত গভীর দর্শন লেখা যায় তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। সে কথা ছাড়াও ‘উত্তরকাণ্ড’ অধ্যায়ে মানুষের চরিত্রের উপমাসহ বিশ্লেষণও অত্যন্ত উপভোগ্য শুধু না কখনও কখনও মনে হয় মনোবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীরাও একবার চোখ বুলিয়ে দেখতে পারেন। খুব হতাশ হওয়ার মত নয়।
কিন্তু সে তাত্ত্বিক আলোচনার জন্য এ লেখাটা লিখতে বসিনি। এই যে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি আজ বাংলায় বাজছে, যে রাম সত্যিই বাংলায় সেই অর্থে কোনোদিন তেমন প্রধান দেবতা হিসাবে পূজিত হতেন না, সেই রামের নিজের বক্তব্য কি নিজের পছন্দ অপছন্দ বিষয়ে? আসলে দুই ধরণের পুজো আছে। এক আবেগের, এক অনুসরণের। যখন কেউ কোনো দেব-দেবী যেমন কালী, গণেশ, বিশ্বকর্মা, লক্ষ্মী, সরস্বতী ইত্যাদিকে পুজো করছেন, তখন তিনি বিশেষ কোনো কামনায় পুজো করছেন বলা যায়। কারণ সেই দেবদেবীরা কখনও সেই অর্থে মানব চরিত্রে গাঁথা হননি। সেখানে 'কোড অব কন্ডকাক্ট' -এর চাইতে স্তবের প্রাধান্য বেশি। কিন্তু ভারতে রাম ও কৃষ্ণ – দুই নারায়ণ অবতারের উপদেশে কোড অব কণ্ডাক্টের কথা আছে। সেখানে একটা মোদ্দা কথা হল – কেউ বিশ্বাস করে, বা পুজো করে, বা কোথাও মাথা নীচু করেও কোনো বিশেষ ধর্মের হয়ে উঠতে পারেন না। তাকে ‘হয়ে উঠতে’ হবে। যেমন 'শৈল-উপদেশ' দেওয়ার পরেই খ্রীষ্ট সাবধান করে দিয়েছিলেন যে এই কোড অব কণ্ডাক্ট অনুসরণ না করে শুধুমুধু আমার নাম নিয়ে চিল্লামেল্লি করলে খুব একটা লাভ হবে না, আমি সাড়া দেব না, এও তেমন। গীতাতেও দ্বাদশ অধ্যায়ে ভক্তের কোড অব কণ্ডাক্ট বলে শেষে সাবধান করে দিয়েছেন যে, এই সব হলে তবেই তুমি আমার ভক্ত। নচেৎ রাস্তা দেখো। সেখানে কোথাও চন্দন, তিলক, কণ্ঠী ইত্যাদির কথা বলা হয়নি, বলা হয়েছে পুরোদস্তুর মানুষ হয়ে ওঠার কিছু ব্যবস্থাপনা। “অদ্বেষ্টা সর্বাভুতানাং” দিয়ে যে শ্লোকগুচ্ছের শুরু। অর্থাৎ, বলাই হচ্ছে সর্বভূতে হিংসারহিত হওয়া দিয়ে প্রথম পাঠ। সব শ্লোক পাঠের পর যদি কেউ প্রশ্ন করেন যে কিন্তু এইসব তো আমার স্বভাবে নেই, তবে? তখন বলা হচ্ছে, অভ্যাস করো শ্রদ্ধার সাথে, তাতেও তুমি আমার প্রিয় হবে।
অর্থাৎ কিনা রাম বা কৃষ্ণের ভক্ত হতে গেলে জিভের চাইতে চরিত্রের অনুশীলন চাই বেশি, অন্তত এমনটাই এই দুই মহারথী দাবি করেন। এখন গীতা মোটামুটি সব না হলেও বেশিরভাগ বাঙালী বাড়িতে থাকবেই ধরে নিয়ে যারা না পড়েছেন তাদের দ্বাদশ অধ্যায়ের ভক্তের লক্ষণ পড়ে নেওয়ার ভার দিয়ে আমি আমার আলোচনার দিকে এগোই, রামের কি মত? তুলসীদাসজী কি বলেন শুনি।
কহহু ভগতি পথ কবন প্রয়াসা। জোগ ন মখ জপ তপ উপবাসা।।
সরল সুভাব ন মন কুটিলাঈ। জথা লাভ সন্তোষ সদাই।।
“ভক্তিপথে কি এমন পরিশ্রম করতে হয় বলুন,” রাম তার রাজ্যবাসীকে উপদেশ দিচ্ছেন; আরো বলছেন, “যা দরকার তা হল, সরল স্বভাব, কপটতাহীন মন আর যা পাওয়া যায় তাতেই সন্তুষ্ট চিত্তে থাকা।“
মোর দাস কহাই নর আসা। করই তৌ কহহু কহা বিস্বাসা।।
বহুত কহউঁ কা কথা বঢ়াঈ। এহি আচরন বস্য মৈঁ ভাঈ।।
“আমার সেবক বলে যদি নিজেকে মনে করেন তবে কেন অন্য মানুষের মুখাপেক্ষী থাকবেন? তবে আর খাঁটি বিশ্বাস কি করে হল বলুন? যা হোক অনেক বলেছি আর কি বলি, শুধু বলি এই আচরণের আমি বশীভূত।”
এই আচরণের কথা ‘চৈতন্য চরিতামৃত’-তেও আছে, “কৃষ্ণেরে ভক্তি করে, করে লোকাপেক্ষা / কৃষ্ণ না করেন কৃপা তারে করেন উপেক্ষা”। (স্মৃতি থেকে লিখলাম, শব্দ একটু এদিক ওদিক হতে পারে।)
কি আচরণের? বলছি।
“বৈর না বিগ্রহ আস ন ত্রাসা। সুখময় তাহি সদা সব আসা।।
অনারম্ভ অনিকেত অমানী। অনঘ অরোষ দচ্ছ বিগ্যানী।।“
“না শত্রুতা যার, না তো বিবাদ-কলহ, না প্রবল আশা, না ভীত যে মানুষ তার তো চারদিক এমনই সুখময়। সে কোনো কিছুই না বুঝেশুনে আরম্ভ করে দেয় না, নির্দিষ্ট বাসস্থানহীন, ‘আমিত্ব’হীন, পাপহীন, ক্রোধহীন, তৎপর ও অনুভবী – এই হল তার পরিচয়।“
আবার কৃষ্ণদাস কবিরাজজী রচিত ‘চৈতন্য চরিতামৃত’ স্মরণ করি। তিনি বলছেন, কে কৃষ্ণ নাম নেওয়ার যোগ্য?
“তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা।
অমানিন মানদেন কীর্তনীয়ঃ সদা হরিঃ।।“
“উত্তম হঞা আপনাকে মানে তৃণাধম।
দুই প্রকারে সহিষ্ণুতা করে বৃক্ষসম।।
বৃক্ষে যেমন কাটিলেও কিছু না বোলয়।
শুকাইয়া মৈলে কারে পানী না মাগয়।।
সেই যে মাগয়ে তারে দেয় আপন ধন।
ঘর্ম্ম বৃষ্টি সহে আনের করয়ে রক্ষণ।।
উত্তম হঞা বৈষ্ণব হবে নিরাভিমান।
জীবে সম্মান দিবে জানি কৃষ্ণ-অধিষ্ঠান।।
এইমত হঞা যেই কৃষ্ণ নাম লয়।
শ্রীকৃষ্ণচরণে তার প্রেম উপজয়।।“
অর্থাৎ কিনা, হাতে ঝুলি গলে কণ্ঠি, কিম্বা উল্লাস চীৎকারে সে পথে হাঁটা হয় না। তার জন্যে রীতিমত কোড অব কণ্ডাক্ট বলা হচ্ছে। সেসব মেনে চললেই গতি, নইলে দুর্গতি।
এবার শেষ করি শেষ দুটো শ্লোক শুনি 'রামচরিতমানস' থেকে বলে এই ধারাতে।
প্রীতি সদা সজ্জন সংসর্গা। তৃন সম বিষয় স্বর্গ অপবর্গা।।
ভগতি পচ্ছ হঠ নহিঁ সঠতাঈ। দুষ্ট তর্ক সব দূরি বহাঈ।।
মম গুন গ্রাম নাম রত গত মমতা মদ মোহ।
তা কর সুখ সোই জানই পরানন্দ সন্দোহ।।
“সজ্জন মানুষের সাথে সঙ্গ করার যার সদা অভিলাষ, যিনি স্বর্গসুখ, মুক্তিসুখ দুইই খড়কুটোর ন্যায় ত্যাগ করেছেন, যিনি ভক্তিপথে আমোদিত থাকেন, কিন্তু জেদ ধরে থাকেন কোনো কিছুতেই বা দুষ্ট তর্ক বাধিয়ে মনের শান্তি নষ্ট করেন না।
আমার নাম গুণগান করেন নিজের মনের থেকে মোহ, অহংকার, আমিত্ববোধ দূরে সরিয়ে, তিনিই পরমানন্দ সুখে আত্মমগ্ন থাকেন জেনো।“
এই হল কথা। রাম নাম উচ্চারণের যোগ্যতা। রামের পদানুসরণের যোগ্যতা। এখন কথা হচ্ছে এসব লিখে বা বলে কি হবে? আমার কথা হচ্ছে না লিখে না বলেই বা কি হবে? যদি শুনেই সব শুধরে যেত তবে তো কৃষ্ণ গীতাটা দুর্যোধনকেই শোনাতেন, তাই না? কিন্তু তা তো শোনান নি। সে-ই শুনতেই বা চাইবে কেন? সজ্জনের উপর তো তার ভারি বিদ্বেষ? সে সাধু সহ্য করে নেবে কিন্তু মহাত্মা নয়। তবু এই কথাগুলো লিখে রাখলাম। নতুন রামপ্লাবন তো, আমার নিজেরও যেন ভুল না হয় কোনটা আত্মহারা সাগর আর কোনটা অ্যাকুয়াটিকা চিনতে, তাই।