বহুকাল হল মহালয়ার দিন সকালে রেডিও চালাই না। না তো ইউটিউবে মহালয়া চালাই। চালালেই বুকের মধ্যে করাত চলে। সময়ের পর সময় ভেঙে ভেঙে সে সময়টা জ্বলজ্বল করে ওঠে যখন হাওড়ার সালকিয়ায় থাকতাম। ছোটো ছোটো তিনটে ঘর। ঠাকুমার। জেঠুর। আমাদের। অত ছোটো ঘর। চারদিকে থইথই কত মানুষ। অন্ধকার ভোরে তিনটে ঘরে রেডিও চলছে। আমি আর দিদি আমাদের ঘর থেকে বেরিয়ে ঠাকুমার কোলের কাছে গিয়ে শুয়েছি। ঠাকুর্দা গেছেন গঙ্গাস্নানে। তর্পণ করে ফিরবেন। দেওয়ালের ওই উঁচুতে চৌকো খোপে রাখা বড় রেডিও। মহালয়া চলছে। আমি দস্যি দুর্গার সঙ্গে দুষ্টু অসুরের লড়াইটা কল্পনা করে ভীষণ একটা অ্যাডভেঞ্চারের মত কিছু অনুভব করছি। সঙ্গে ভাবছি এই তো সামনে পুজো.... কী কী করতে হবে।
একটু যেই আলো ফুটল, অমনি সামনের টানা এক চিলতে বারান্দায় এসে দাঁড়াই। সামনের জানলাটা পুবদিকে। জানলার লোহার রডগুলোর ফাঁক দিয়ে দিয়ে ওদিকের খাটাল আর অশ্বত্থগাছটা পেরিয়ে রোদ এসে পড়েছে মেঝেতে। এই মেঝে দিয়ে একটু পর হুটোপুটি চলাচল হবে। ঠাকুমা, ঠাকুর্দা, জেঠু, জেঠিমা, মা, বাবা আর আমরা চারভাইবোনেদের। রান্নাবান্না হবে। কাগজ পড়বে বাবা জ্যাঠা ঠাকুমা। চা খাওয়া হবে। পাড়ার কেউ কেউ আসবে। হইহট্টগোল হবে। গল্প হবে।
তারপর? আজ? হঠাৎ সব ফাঁকা। কত মানুষ নেই। আছে মহালয়া। আর বাকিদের সঙ্গে শুধু তর্পণের সম্পর্ক। এমনকি ছোটো ভাইটার সঙ্গেও। করোনা তো বয়েস বাছেনি। বয়েসের সঙ্গে মৃত্যুর ধারাপাতের নামতা তো ছিল আমার বানানো। ভাগ্য তা শুনবে কেন? শোনেওনি। সব তছনছ করে ছিন্নভিন্ন করে চলে গেছে।
আজ আর তাই মহালয়া শোনা হয় না। শুনতে পারি না। সেদিনের বারান্দায় এসে পড়া একফালি রোদ যে এমন উজ্জল হয়ে স্মৃতির বারান্দায় কাঙালের মত বাঁচবে, কে জানত? কে জানত, সেদিনের ঘুঁটে কয়লার উনুনের আঁচের ধোঁয়ায় আজও আমার চোখ জ্বালা করবে। গলার কাছে অসহায়ের মত কান্না দলা পাকিয়ে থাকবে?
স্মৃতি বড় স্বার্থপর। যেখানে যা কিছু ভালোবাসা, সুখ পেয়েছে, সে সব হারিয়েছে যখন, সে সব কিছুর জন্য তার হাহাকারের শেষ নেই। কিন্তু একবারও তার মনে পড়ে না, যাকে যা দেওয়ার ছিল দেওয়া হয়েছে কি? জানি না। যার কাছে ক্ষমা চাওয়ার ছিল, যার কাছে যা বাকি ছিল সেকি পূরণ হয়েছে? হয়নি। ঋণ না থাকলে বেঁচে থাকার তাগিদটাই তো ফুরিয়ে যায় মানুষের। পার্থিব জগতের টাকাকড়ির ঋণ গলার ফাঁস, যত তাড়াতাড়ি তার থেকে মুক্ত হওয়া যায় তত শান্তি। অপার্থিব জগতের ঋণের হিসাব উলটো, সে গলার ফাঁস না, প্রাণের আশ। সে যত বাড়ে জীবন তত অর্থময়। যত কমে জীবন ততটাই অর্থহীন। প্রতিটা দিন অল্প অল্প করে সে ঋণ শোধ করার খেলা। পূরণ হবে না জেনেও। কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁর কালজয়ী মহাগ্রন্থ, 'চৈতন্য চরিতামৃত' তে লিখছেন, চৈতন্যদেব হলেন অসীম আকাশ। আমি আমার ক্ষুদ্র ডানায় ভর করে যতটা উড়তে পেরেছি ততটাই মহাপ্রভুর কথা লিখেছি। আমার ডানার শক্তিতে, আমার উড়বার ক্ষমতার উপর শ্রীমহাপ্রভুর অসীম ক্ষমতার পরিমাপ করবেন না যেন। আমার পক্ষে সে মাধুর্য অধরাই।
জীবনের মাধুর্য এমনই অধরা। জীবন আঘাতের পর আঘাতে এটুকুই শেখায়, যে কান্নাহাসির মাঝ দিয়ে একটা সিলভার লাইন আছে। সেটুকু ধরতে পারলেই খেলা জমে যায়। সে সিলভার লাইনটা কী, সে ভাষায় বলা যায় না। তোমাকে নিজেকে খুঁজে বার করতে হবে। খেলাটা শিখতে হবে।
রোজ চাইছি অল্প অল্প করে খেলাটা শিখতে। সব শোক, সব দুঃখ, সুখের আস্পৃহা থেকে ঊর্ধ্বে উঠে জীবনের যে উদাস ছন্দ তার সঙ্গে চলতে। অলকানন্দা মন্দাকিনীর সঙ্গমের সামনে দাঁড়াতে, যেখানে সসীমের মধ্যে অসীম এসে মেশে। পথ কঠিন। কিন্তু এটাই তো রাস্তা। হাঁপিয়ে পড়ছি থেকে থেকে। আবার হাঁটছি। জন্ম থেকে মৃত্যু এই হেঁটে চলাটাই তো আদ্যোপান্ত তীর্থ। সঙ্গে চলেছে কয়েকজন তীর্থযাত্রী। এইটুকুই তো সম্বল। বাকি কী আছে? বাকির খোঁজ নেই আর। শুধু পথটুকুই আছে। তুষারাবৃত নিষ্ঠুর জীবনের পাকদণ্ডী বেয়ে বেয়ে চলা আছে। ব্যথা আছে। আর আছে গভীর শূন্যতার মধ্যে জেগে থাকা একজোড়া চোখ। সে চোখে দরদ, না উদাসীনতা, কে বলবে?