সৌরভ ভট্টাচার্য
2 February 2018
তুমি তোমার মূর্খামিতে খাঁটি
এ নিয়ে নাই সন্দেহ
কিন্তু তোমার মূর্খামির সাথে কি করে হাঁটি?
আপনি শপিং মলে কেন যান? আগে গুচ্ছের টাকা বাণ্ডিল করে বাইরে যেতেন, এখন ডেবিট, ক্রেডিট কত কার্ড। আবার ডেবিট কার্ডেরও কত প্রকার। এত কার্ডের বহর কেন? আগে গান শুনতে একরকম ক্যাসেট, সিনেমা দেখতে আরেক রকম ক্যাসেট ছিল, এখন নেই; সব সিডি, পেনড্রাইভে কেন?
মোদ্দা কথাটা হল মানুষ একটা প্যাকেজ চায়। আগে ঘুরে ঘুরে বাজার করা হত, এখন একটা বড় বিল্ডিং-এ ঢুকে যাও, সব আছে। এত টাকা নিয়ে ঘুরব কেন? এক টুকরো প্লাস্টিক যন্ত্রে ঘষলেই টাকা বেরোবে – প্যাকেজ। একটু ভালো করে ভাবলেই দেখা যাবে, আমরা সব কিছুকে সহজ করা বলতে একটা ছন্দে বা একটা সিস্টেমে আনতে চেষ্টা করে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি।
ধর্ম – প্রাচীনতম প্যাকেজ। কি করে? আসছি, তার আগে আরো খানিক গৌরচন্দ্রিকা করা বাকি। মানুষ আবেগ আর বুদ্ধির একটা সমন্বয়। কোনো প্রাণীর ‘কারণ’ লাগে না বাঁচতে। মানুষের লাগে। কোনো প্রাণীর ব্যাখ্যা লাগে না কোনো কিছুর। মানুষের লাগে। এত প্রশ্ন, এত জিজ্ঞাসা, এত অনিশ্চয়তা, এত দ্রুত পরিবর্তনশীল জগতের এত বৈচিত্র্যময়তা – মানুষ ভয় পেয়েছিল। ইতিহাস সাক্ষী। সে জল, আকাশ, আগুন, বাতাস ইত্যাদিকে পারসোনিফায়েড করে একটা ব্যাখ্যা খুঁজেছিল। তাও হল না। তার আরো বড় কোনো ব্যাখ্যা দরকার হয়ে পড়ল। যাতে এই নানা বিরুদ্ধ ব্যাখ্যারা একটা জায়গায় দাঁড়াতে পারে। একটা পরম ব্যাখ্যা – তার একেশ্বরবাদ।
কিন্তু মুশকিল হল মুসলিমের সেই 'এক'র সাথে, হিন্দুর 'এক' মিলল না। হিন্দুর 'এক'র সাথে খ্রীষ্টানের 'এক' মিলল না। সে অন্য কথা। এক অনন্তে নানা অনন্ত। কি করে হয়? হয় না তো! তবু হয়। আর তার থেকে বড় ট্রাজেডিটা হচ্ছে ধর্মের মহৎপ্রাণ মানুষের সংখ্যার চাইতে ধর্মের অন্ধ অনুসারীর সংখ্যা এত বেশি যে প্রথম জনেরা দৈনন্দিন সামাজিক জীবনে প্রায় ঠাঁই-ই পান না। আমির খুসরু'র ধর্মবিশ্বাসের প্রভাব আর লাদেনের ধর্মবিশ্বাসের প্রভাব তুলনা টানলেই বোঝা যাবে। এ তো গেল অনেক বড় ক্ষেত্রে উদাহরণ। প্রতিদিনের জীবনে কত মানুষের প্রাণ সংশয় হচ্ছে, বেঁচে থাকা অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে এই প্রবল ধর্মবিশ্বাসের ফলে সে কি চোখে আঙুল দিয়ে আর দেখানোর প্রয়োজন আছে?
আমাদের সামনে সত্যিকারের দুটি বড় চ্যালেঞ্জ – এক ধর্ম নিজে। আর দুই নানা ছদ্ম বিজ্ঞানবেশী ধর্ম। দ্বিতীয়টা বেশি ভয়ংকর। কারণ সে ছদ্মবেশে মারে। ‘ধর্ম ও বিজ্ঞান’ – নামক যে ক'টা বই বাজারে পাওয়া যাচ্ছে তার একটু গভীরে আলোচনা করতে গেলেই বিপদ। বক্তাও চান না, শ্রোতাও চান না। কেন চান না? আর সেটাই আমার আলোচ্য বিষয়।
এইটা লিখব কেন মাথায় এলো? কাল একটা ভূমিকম্প হল দিল্লীতে। কাল সুপারমুনের ওপর নানা শো ছিল। আমার অত্যন্ত পরিচিত দু'জন শিক্ষিত মানুষের আলোচনার বিষয় ছিল, এই দুটির মধ্যে সাদৃশ্যতা। সে আলোচনার বিশদ বিবরণে যাওয়ার মত রুচি আমার নেই। কিন্তু কেন তারা যেতে চাইছেন না এই প্রাচীন বিশ্বাসগুলোর বাইরে?
কারণ একটাই – প্যাকেজ কেন ছাড়ব? প্যাকেজের নিশ্চিন্ততা কেন ছাড়ব? বিজ্ঞান আমায় ‘কি করে’ বলতে পারবে। ‘কেন’ ব্যাখ্যা দিতে পারবে? পারবে না। তাই আমি শুনবও না। কি করে বাঁচতে হবে, কি করে জীবন ধারণ করলে আমার কোনো বিপদ হবে না, আমার কোনো ক্ষতি হবে না। আমার মৃত্যুর অন্ধকারে সবটুকু আশা-ভরসা শেষ হয়ে যাবে না, সে খবর বিজ্ঞান দিতে পারবে? পারবে না। তাই আমিও শুনব না। ধর্ম আমাকে সব কিছুর ব্যাখ্যা দিতে পারে। সব কিছুর একটা উদ্দেশ্য দিতে পারে। আমায় ভালো হতে, আমায় স্বজনের জন্য স্বার্থত্যাগ করতে, আমায় কারা পাপী, কারা শত্রু, তাদের মারতে, তাদের ঘৃণা করতে, ঘৃণা না হলেও করুণা করতে, একজন রাজার মত, মায়ের মত, বাবার মত, বন্ধুর মত, স্বার্থগন্ধহীন সুহৃদের মত অদৃশ্য শক্তিকে হাতের নাগালে দিতে... ইত্যাদি ইত্যাদি কত শিক্ষা দিয়েছে, দিয়ে আসছে। আমি কেন ছেড়ে দেব? আমি কেন এ কম্ফোর্ট জোন ছেড়ে বাইরে আসব? বিজ্ঞান আমার দাস। বিজ্ঞান আমার ভীতি নিবারক। কিন্তু বিজ্ঞান আমার দোসর হতে পারে না! কারণ বিজ্ঞানকে পার্সোনিফায়েড করা যায় না! যদি মাধ্যাকর্ষণ বল নিউটনের পূজায় আমার সখ্যতা স্বীকার করে, তবে নিশ্চয় বিজ্ঞানকে আমি আমার অন্দরমহলে ঠাঁই দেব, নইলে কেন? সে থাকুক আপন নৈর্ব্যক্তিক সত্তা নিয়ে বাইরের দরজায়। ডাক পড়লেই যেন হাজির হয় – তাহলেই হবে। এই হল আমাদের মোটের উপর ধর্ম আর বিজ্ঞানের সহাবস্থান। তা হলে কেন বের হব? কে বার করতে চাইবে? চলছে তো দুটোই পাশাপাশি।
কথাটা কি তবে আস্তিকতা বা নাস্তিকতা নিয়ে? আদৌ তা নয়। আস্তিক তো সবাই। যখন সে একা, নিজের সাথে এই বিশ্ব চরাচরের যে একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে, সেই সম্পর্কের মাধুর্যে বুঁদ হওয়াই তো আস্তিকতা। আমার বোধের গভীরে একটা গভীর বোধ আছে যার আলোতে আমি জ্ঞাত হই আমার জ্ঞানের অস্তিত্বকে। সেই তো আমার অন্তর্যামী। সে কি পারসোনিফায়েড? হ্যাঁ, আবার না। 'হ্যাঁ', কারণ আমি পার্সোনিফায়েড। আমার সেই পার্সোনিফায়েড হওয়ার প্রবৃত্তির বাইরে যাওয়ার চেষ্টা আমি যতই করি না কেন, তা কিছুতেই খাঁটি হওয়ার নয়। তাই সব সত্যই কোথাও শেষে গিয়ে –মানবসত্য। আবার পাশাপাশি ‘না’, কারণ আমার ভিতরেই একটা নৈর্ব্যক্তিক সত্তা আমায় রাতদিন আমার সীমার বাইরে যেতে আমায় ডাকছে। তবে দাঁড়াব কোথায়? কোনো একটা তত্ত্বে বা মতে দাঁড়াবার নেই। একটা নৌকা হলে চলমান স্রোতের মধ্যে বেয়ে চলা যায়, সেই নৌকাটা আমার বোধ। সে ব্যক্তিও বটে আবার নৈর্ব্যক্তিকও বটে।
সমস্যাটা এত অবধি জন্মায় না। সমস্যাটা জন্মায় যখন আমি সে মরমী সম্পর্কের জায়গায় দল পাকিয়ে নিজের জগৎ তৈরিতে মাতি আমার নিজের ব্যাখ্যায়, নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থবুদ্ধির অনুকরণে। তাতে আরাম মেলে, সুরক্ষা মেলে, স্বস্তি মেলে – সত্য মেলে না। ফলে ধর্মের সামগ্রী শুধু বাণী হয় না, বোমও হয়। যে শেখায় সে যখন অনুকরণকেই সমস্ত সত্যের মূল ভিত্তি মনে করে, তখন ভয় আর আশঙ্কা তাকে আরো বর্বর করে অনায়াসে তুলতে পারে। যে বর্বরতাকে সে নিষ্ঠা আর ব্রতের আড়ালে ঢেকে রাখে।
এ তো গেল ধর্মের ভয়। এর থেকেও ভয়ংকর আমাদের ছদ্ম-বিজ্ঞান। যেখানে নাকি আত্মার অস্তিত্ব আর পদার্থ বিজ্ঞানের অস্তিত্ব মিলেমিশে একাকার হয়ে উঠছে। এটা বিষাক্ত চর্চা। এর বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ালে আগামী প্রজন্মের অবস্থা হয়ত বা আমাদের থেকেও সঙ্গীন হবে। কারণ ঠাকুমার চন্দ্রগ্রহণে খাবার বর্জনের থেকে ভয়ংকর, বেদান্তের প্রমাণের সাপেক্ষে পদার্থবিদ্যার ব্যবহার। সাবধান হতে হবে, আরেকটা অন্ধকার যুগের সূচনার আগেই।