অবশেষে এক দীর্ঘকালীন মাইক উৎসব শেষ হল। দেবী কখনও দশভূজা, কখনও চতুর্ভূজা, কখনও দ্বিভূজা হয়ে নানা বাঁশবাটিকায় পুজো নিয়ে ফিরলেন। কখনও হিন্দি, কখনও বাংলা, কখনও ভোজপুরি… ইত্যাদি কোন গানে দেবী বেশি প্রসন্ন হন ঠাহর করতে না পেরে পুজো কমিটিরা তাদের যথাসাধ্য চেষ্টাও করল। অবশ্যই সেই আদিকাল থেকে শুধু সংস্কৃত মন্ত্রে যে কারোর মন ভরে না সেটা তো যে কেউই বুঝতে পারে, তাই না?
কথা হচ্ছে এইবার কি হবে? সামাজিক দায়িত্ব বলতে যে চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য মাঝারি কি ছোটো ইত্যাদি ধরণের যাই হোক না কেন, তার বাইরে এবার কি করার আছে? জীবিকা নির্বাহ এক বড় কাজ। তারপরে নানা ওয়েব সিরিজ, সোশ্যাল মিডিয়া ইত্যাদিতে চিত্তের তৃপ্তির রাস্তাও না হয় খোঁজা গেল, কিন্তু এরপর কি হবে? খেলা আসছে, হ্যাঁ। বিশ্বকাপ ফুটবল। ক'দিন কয়েকটা বিদেশী দেশের নাম নিয়ে বেশ কোন্দল হবে। হোক। আদতে তবে আমরা ঠিক কোথায়?
কিন্তু এই যে পুজো পুজো বাতিক বাঙালিকূলের ঠিক অবস্থানটা এখন কোথায়? শ্যামাপোকারা শীতের আগে কোথায় থাকে সৌমিত্র?
বাঙালির আগে একটা পরিচয় ছিল, শাক্ত বনাম বৈষ্ণব। এখনও এদিক ওদিক তাকালে দেখা যায় সে প্রজন্মের বাঙালি যে নেই তা বলি না, আছে তবে কম। কিন্তু এখন বাঙালির লোকাচার, কি ধর্মাচারের ঠিক অবস্থানটা কোথায়?
এক কথায় বলা মুশকিল। যদি ভাবি বাঙালি দর্শন এখন ঠিক কোন জায়গায়? দর্শন বলতে আমি ধর্মীয় দর্শনের কথা বলতে চাইছি। স্পষ্ট তেমন কিছু নেই আজ। এক কালে বাঙালি ন্যায়দর্শন চর্চা করেছে। তারপরে বৈষ্ণব দর্শন। তারপরে কতিপয় শহুরে বাঙালি খ্রীষ্টধর্মের আঙ্গিকে ব্রাহ্ম দর্শনে মেতেছে। যা কিছুটা উপনিষদ আর বাইবেলের ককটেল ধরণের। পিতার উপাসনা হয়েছে। মায় কেশব সেনের জীবনেও শেষের দিকে বাইবেল শোনার কথা পড়েছি কোথাও। তারপর?
রামকৃষ্ণ ঠাকুর আর বিবেকানন্দের মাধ্যমে বাঙালির প্রাণে এক দেশাত্ববোধক ধর্মীয় দর্শন এককালে ভালো প্রভাব ফেলেছিল। আমাদের অনেক বিপ্লবী অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হল। স্বামীজির “শিবজ্ঞানে জীব সেবা” ততটা বাঙালি জীবনের মূল ধারাকে অনুপ্রাণিত করল না, যতটা করল রামকৃষ্ণ ঠাকুরের অবতারতত্ত্ব। দলে দলে মানুষ দীক্ষা নিতে শুরু করল। এক নতুন সম্প্রদায় গড়ে উঠল। যারা নিজেদের অত্যাধুনিক মনে করল। কারণ স্বামীজির মতে রামকৃষ্ণ ঠাকুর বিষ্ণুর নবতম সংস্করণ। এখন স্বামীজি যে উদ্দেশ্যেই বলুন, ‘ভদ্রলোক’ বাঙালি জাতির মনে এই ভাবটা বেশ একটা নতুন ধারা নিয়ে এলো। তারা গত বৈষ্ণবদের কিছুটা অশিক্ষিত ম্লেচ্ছ ইত্যাদি হিসাবে দেখতে শুরু করল। নিজেদের অত্যন্ত যুক্তিবাদী, প্রগ্রেসিভ, উন্নতমনা আধুনিকভাবে দেখতে শুরু করল।
কিন্তু ইতিমধ্যে বাঙালি সমাজে আরো অনেক গুরু এসে গেছেন, রামকৃষ্ণ উত্তর যুগে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ে বাঙালি ভাগ হতে শুরু করল। যেমন রামকৃষ্ণ মিশনগামী বাঙালি, সৎসঙ্গী বাঙালি, ইস্কনীয় বাঙালি, গৌড় মঠীয় বাঙালি, ওঁঙ্কারনাথীয় বাঙালি, আনন্দময়ী মা অনুগামী বাঙালি…..
এখন একটা কথা এখানে উল্লেখ্য যে এরা সব কিন্তু একটা অরগানাইজড ধারায় ভক্ত। এখানে সব সম্প্রদায়ের কিছু আচার অনুষ্ঠান আছে, নির্দিষ্ট উৎসব আছে, যেমন নিজের নিজের গুরু জন্ম উৎসব ইত্যাদি। এখানেও একের প্রতি অন্যের “আমি বেশি ঠিক” ভাব বর্তমান।
তবে বাঙালির ধর্মীয় দর্শনটা ঠিক কি আজ?
এখানেই একটা মজার দিক আছে। উপরি উক্ত সবই শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত আর কিছুটা উচ্চবিত্ত বাঙালির মধ্যে সীমাবদ্ধ। এখানে তেমন কোনো দর্শন নেই। যে যার সম্প্রদায়ের কিছু কিছু বইকে, যা সাধারণত সেই সব সম্প্রদায়ের কেন্দ্রীয় পুরুষ বা নারীর বাণী, কিছু স্তব-প্রার্থনা ইত্যাদিকে নিয়ে আছেন।
এর বাইরে আছে এক বিশাল সম্প্রদায়, যারা সতীমায়ের অনুগামী, মতুয়া, বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের বাঙালি। আর আছে বাউল।
এখানে একটা দিক অবশ্য করে বলার, এই যে ‘ভদ্রলোক’ সম্প্রদায়ের বাইরে যে বিশাল ধর্মীয় দিক, তার প্রধান প্রাণপুরুষ অবশ্যই শ্রীচৈতন্য ও নিত্যানন্দ। বাউলের গানে, মতুয়ার লেখায়, সতীমায়ের ভাবগীতিতে সেই এক মহাপ্রভুর শিক্ষা দেখা যায়। কারণটা অবশ্যই স্পষ্ট। বাঙালির ইতিহাস পড়তে গেলে শ্রীচৈতন্য অধ্যায়কে বাদ দিয়ে যেহেতু যাওয়া যায় না।
বাঙালির এই ‘ভদ্রলোক’ স্তর চিরটাকাল বারবার পরিবর্তন হয়েছে। এক গুরু থেকে আরেক গুরুতে এসেছে। কোনো ভাবই তেমন গভীরে স্পর্শ করেনি তাদের। তারা ভীষণ স্ব-জাতি সচেতন। আবার এমন অনেক উদাহরণও দেখেছি যে তথাকথিত অভদ্রলোকীয় স্তর থেকে আসা মানুষ ভদ্রলোকীয় স্তরে ঢুকে নিজেদের পরিবর্তন করে নিয়েছেন। তারা নিজেদের মতুয়া ইত্যাদি পরিচয় থেকে বার করে আনার চেষ্টা করছেন। আবার অনেকে করছেন না, এমন উদাহরণও আছে।
বাঙালির ধর্মীয় দর্শন বলতে তবে দাঁড়ালো, একদম সাধারণ স্তরে মহাপ্রভু প্রচারিত জটিল দার্শনিক তত্ত্বহীন মানবিক শিক্ষা। তারও বিকৃতি যে হয়নি তা ঠিক নয়, হয়েছে, তবু একরকম টিকে আছে।
আরেক দর্শন হল কলোনিয়াল যুগের সংঘাতে জেগে ওঠা নানা ধরণের দেশাত্ববোধক চিন্তা। সেই দেশাত্মবোধক ধর্মীয় দর্শনকে জাগাতে অনেকে কিছুটা মনুসংহিতা নির্দেশিত বর্ণাশ্রমের সঙ্গে আধুনিকতাকে মিশিয়ে এক তত্ত্বও দাঁড় করাতে চেয়েছেন। পরবর্তীকালে তা অবশ্যই নানাবিধ জীবিকার কারণে বাঙালিকূলের পক্ষে মেনে চলা সম্ভব হয়নি সব অর্থে। একমাত্র পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপন আর পুজোবিধি ছাড়া তার নিদর্শন খুব একটা চোখেও পড়ে না।
তবে এর মধ্যে বেশ কিছু দিকে রামকৃষ্ণ ঠাকুরের চিন্তার মধ্যে একটা স্বকীয়তা ছিল। মৌলিকত্ব ছিল। ভাষাতেও। সে আলাদা প্রসঙ্গ। কারণ রামকৃষ্ণ ঠাকুরের দর্শনকেও আন্তরিকভাবে নিলে বাঙালির আজ এই উগ্র সার্বজনীন মাইকোৎসব হত না। রবীন্দ্রনাথ একবার খুব ক্ষোভের সঙ্গে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশকে লিখছেন যে, বাঙালি না তো মহাত্মার অহিংসাকে আন্তরিকভাবে নেওয়ার উদারতা দেখিয়েছে, না তো সশস্ত্র বিপ্লবে খুব জোরের সঙ্গে রাস্তায় নেমেছে। আরো লিখছেন যে মারার বেলায় যাদের চালাকির অভাব হয় না, আর মার খাবার বেলায় যাদের নালিশ আকাশকে ছোঁয় তাদের খুব একটা উচ্চাসনে জগত বসায় না।
তবে এর মধ্যেও অসম্প্রদায়ভুক্ত, বামচিন্তাবিদ, অধর্মীয় বাঙালিকূলও আছে। কিন্তু সে বাম জামানাই হোক কি আজকের সরকার, বাঙালির প্রাণঘাতী মাইক সর্বস্ব উৎসব, বাঙালির পাত্রপাত্রী বিজ্ঞাপনে জাতকুল বিচার চলে এসেছে। অনেক নাস্তিক বাড়িতে ঘটা করে পৈতেও দেখেছি। শ্রাদ্ধও দেখেছি। আসলে নাস্তিকতা যতটা প্রচারের জিনিস ততটা আচরণে আর বিশ্বাসের জিনিস হয়ে ওঠেনি। নইলে একমাস ধরে প্রায় কর্মনাশা উৎসব করে অর্থনীতি চাঙ্গা করার কথা তো ভাবাই যেত না, না?
এরপরে আসে একে তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ। দেখেছি ভদ্রলোক গোষ্ঠী অভদ্রলোকীয় সম্প্রদায়ের উৎসব নিয়ে, আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে অদ্ভুত উন্নাসিক ভাব দেখাতে। তাই গণেশ পুজো যতটা আপন হয়, ছট হয় না। কারণটা আর্থসামাজিক, ধর্মীয় দর্শন বা পরিবেশ দূষণ নয়। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মধ্যে আসলে পরোক্ষ আত্মপ্রচার আছে, আমি ওদের মত নই, বা আমি অনেক প্রগ্রেসিভ গোছের কিছু একটা ইমেজ বোঝানোর চেষ্টা। এদিকে বাঙালি কি অনায়াসে তার বিজয়ার শুভেচ্ছা ভুলেছে। বাড়ি গিয়ে প্রণাম করা ভুলেছে। কিন্তু অহংসর্বস্ব তর্ক ভোলেনি। সঙ্কীর্ণ উদ্দেশ্যে মহৎ দর্শনের কুৎসিত ব্যবহার ভোলেনি। এক বইতে দেখলাম, মহাপ্রভু নাকি “নিঃস্বার্থ উদারতার” জন্য ওনার বিপ্লবটা করেছিলেন, যা নাকি “মতলব”, আর “সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি” গোছের। হাসিই পেল এমন গবেষণা দেখে। আসলে গবেষণা প্রমাণ ছেড়ে বিচারের রাস্তায় গেলেই সেই বিচারকারীর নিজের ম্যাচিউরিটি আর অনুভবের সীমাবদ্ধতার দোষে দুষ্ট হয়ে যায়। ফলে দাঁড়ায় সেই শকুনের গল্প, উড়ছে উঁচুতে, দৃষ্টি ভাগাড়ে।
তবে বাঙালির দর্শনের উদারতা এক রামকৃষ্ণ ঠাকুরের রাস্তা চেয়ে ছিল না। কোনো মহত্বই ব্যক্তি মুখাপেক্ষী তো নয়। বাঙলায় এককালে যে বাউল সম্প্রদায় এসেছিল তারাই কি তবে আদতে বাঙালির আসল দর্শনের কাণ্ডারি? যার প্রাণ প্রতিষ্ঠাতা অবশ্যই মহাপ্রভু। মহাপ্রভুই কি বাঙালির সে অর্থে নবজাগরণের প্রথম শিখা? বাউল যার মাটির সব চাইতে কাছাকাছি ধারা? মাঝে কালিকাপ্রসাদের জন্য বাঙালির প্রাণে হুজুগে বাউল ভালোবাসা জেগে উঠেছিল। কারণটা অবশ্যই টিভির গানের রিয়েলিটি শো। আজ? মূল ধারার বাঙালিকূল খোঁজও নেয় না।
বাঙালির দর্শন, গৌরব মাইক বাজিয়ে পাড়া কাঁপিয়ে ইউনেস্কোর বদান্যতায় নয়। বাঙালির দর্শন কীর্তনে, বাউলে, উদারতার ভাব নিয়ে লেখা শ্যামাসঙ্গীতে। কোনো সম্প্রদায়ে নয়। কোনো আশ্রমে নয়। সব আশ্রম উবে গেলেও, সব সম্প্রদায় মুছে গেলেও, বাঙালি নিজেকে ফিরে পাবে উপনিষদে, বেদে নয়, মহাপ্রভুর আকুতিতে, বাউলের একতারায় আর কীর্তনের খোলে। সেখানে মানুষের ডাক, মানুষের প্রাণের ডাক। চোখের জলের সঙ্গে প্রাণের উদারতায় বিশ্বমানবের আবাহন। কিছু যায় আসে না ইউনেস্কো তার খোঁজ রাখুক কি না রাখুক। আপামর মাটির কাছাকাছি বাঙালিকে খুঁজতে গেলে সেখানেই যেতে হবে। কাদাজল মেখে ডিঙ্গিতে উঠতে হবে। ভাটিয়ালির সুরে, কীর্তনের সুরে, বাউলের সুরে মানুষকে জাগাতে হবে।
উৎসব কি হবে? উৎসব হবে, বাউলের আখড়ায়। কীর্তনের আখড়ায়। বাঙালি আবার প্যাণ্ডেল বেঁধে, ভাষণ দিয়ে মানুষকে নিয়ে মাতার কথা ভাবল কবে? সে তো গেয়েছে। সে তো নেচেছে। বিশ্বতানে সুর মিলিয়েছে তার অতি অল্প সহজ আয়োজনে, একটা একতারায়, কি মাটি দিয়ে বানানো খোলে। উদারতা জেগেছে কাব্যে। সহজ হয়েছে সুর। আজ সে বাঙালি কোথায়?