Skip to main content

বাঙালিকে ভ্রমণ পিপাসু যদি বলা হয়, তবে পুরো কথাটা সত্যি হয় না। শীতে পরিযায়ী পাখি আসে কলকাতায়। সে এক আসা। দুর্গাপুজোয় হাজার হাজার বাঙালি এদিক ওদিক বেড়াতে যায়, সে এক বেড়ানো। কিন্তু মানুষ তো পাখি নয়, পশু নয়। মানুষের আরেক ভ্রমণের পথ আছে, তার বিগত মনীষার হেঁটে আসা পথ। তার 'ধী'-এর আলোয় নানা দুর্গম রাস্তা পেরিয়ে আসার পথ। এ ভ্রমণে বাঙালি কতটা উৎসাহী?

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় একটা বই লিখেছিলেন, 'বৌদ্ধধর্ম'। কি দুর্গম পথকে সহজ করে তুলেছিলেন। গীতার উপমাকে স্মরণ করে বলা যায়, পঙ্গুকে গিরি লঙ্ঘন করানোর মত সে লেখা। ইংরাজি ভাষায় লেখা, বহু বিক্রীত হওয়া তথাকথিত বেস্টসেলার বই, যা বৌদ্ধধর্মের নানা জটিলতার উপর লেখা, সে সবের সমতুল্য এ বইয়ের উপস্থিতি, আলোচনা আমাদের মধ্যে কত কম! যে হারে বাঙালি বুদ্ধগয়া পরিভ্রমণ করে, তার ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম অংশও হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মনীষার জগত পরিভ্রমণ করে না। রবীন্দ্রনাথ মনীষাকে মনের চরিত্রবল বলছেন, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে এক জায়গায় লিখছেন,

"যে-কোনো বিষয় শাস্ত্রীমশায় হাতে নিয়েছেন তাকে সুস্পষ্ট করে দেখেছেন ও সুস্পষ্ট করে দেখিয়েছেন। বিদ্যার সংগ্রহ ব্যাপার অধ্যবসায়ের দ্বারা হয় কিন্তু তাকে নিজের ও অন্যের মনে সহজ করে তোলা ধীশক্তির কাজ। এই জিনিসটি অত্যন্ত বিরল। তবু, জ্ঞানের বিষয় প্রভূত পরিমাণে সংগ্রহ করার যে পাণ্ডিত্য তার জন্যেও দৃঢ় নিষ্ঠার প্রয়োজন; আমাদের আধুনিক শিক্ষাবিধির গুণে তার চর্চাও প্রায় দেখি নে। ধ্বনি প্রবল করবার একরকম যন্ত্র আজকাল বেরিয়েছে তাতে স্বাভাবিক গলার জোর না থাকলেও আওয়াজে সভা ভরিয়ে দেওয়া যায়। সেই রকম উপায়েই অল্প জানাকে তুমুল করে ঘোষণা করা এখন সহজ হয়েছে। তাই বিদ্যার সাধনা হাল্কা হয়ে উঠল, বুদ্ধির তপস্যাও ক্ষীণবল। যাকে বলে মনীষা, মনের যেটা চরিত্রবল সেইটের অভাব ঘটেছে।"

শাস্ত্রী মহাশয় যা লিখেছেন, তার মধ্যে ইতিহাস আছে, সমাজ আছে, ভাষা আছে, মনুষ্যত্বের কথা আছে। আরো অনেক অনেক কথা আছে। কিন্তু ক্ষুদ্রতা নেই। মহৎকে কালিমালিপ্ত করার বাচনশৈলী নেই, চাতুরী নেই।

শাস্ত্রী মহাশয়ের একটা প্রবন্ধ আছে, মনুষ্যত্ব বনাম 'সাইন' করা নিয়ে। সাইন করা মানে সই করা নয়, সাইন করা মানে নিজেকে উজ্জ্বলভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার ইচ্ছা। মানুষের ধর্ম, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, সাধ-ইচ্ছা যা কিছুকেই মনুষ্যত্বের বিনিময় সংগ্রহ করতে হয়, যুগে যুগে প্রত্যেক বিবেকবান মানুষই তার উপর সংশয় প্রকাশ করেছেন। উদারতা আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা কোনোদিন এক জায়গায় অবস্থান করতে পারে না। আর উদারতা না থাকলে সত্যের "অনেকান্ত" দৃষ্টিও সম্ভব নয়। তখন সবাই এক পক্ষের সংজ্ঞা চায়, কারণ সেখানে তার স্বার্থসিদ্ধ হয়। উদারতায় স্বার্থসিদ্ধি হয় না। নিজেকে সার্থক মনে হয়। কিন্তু আমি সার্থক হতে চাই, না সফলতায় "সাইন" করতে চাই শাস্ত্রীজীর ভাষায়, সে তো আমার প্রকৃতি, আমার শিক্ষা-রুচির উপরেই নির্ভর করবে।

রবীন্দ্রনাথ শাস্ত্রীজীকে নিয়ে লিখতে গিয়ে আরেক জায়গায় লিখছেন,

"অনেক পণ্ডিত আছেন, তাঁরা কেবল সংগ্রহ করতেই জানেন, কিন্তু আয়ত্ত করতে পারেন না; তাঁরা খনি থেকে তোলা ধাতুপিণ্ডটার সোনা এবং খাদ অংশটাকে পৃথক করতে শেখেন নি বলেই উভয়কেই সমান মূল্য দিয়ে কেবল বোঝা ভারি করেন। হরপ্রসাদ যে যুগে জ্ঞানের তপস্যায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন সে যুগে বৈজ্ঞানিক বিচারবুদ্ধির প্রভাবে সংস্কারমুক্ত চিত্ত জ্ঞানের উপাদানগুলি শোধন করে নিতে শিখেছিল। তাই স্থূল পাণ্ডিত্য নিয়ে বাঁধা মত আবৃত্তি করা তাঁর পক্ষে কোনোদিন সম্ভবপর ছিল না। ভূয়োদর্শনের সঙ্গে সঙ্গে এই তীক্ষ্ণদৃষ্টি এবং সেইসঙ্গে স্বচ্ছ ভাষায় প্রকাশের শক্তি আজও আমাদের দেশে বিরল। বুদ্ধি আছে কিন্তু সাধনা নেই এইটেই আমাদের দেশে সাধারণত দেখতে পাই, অধিকাংশ স্থলেই আমরা কম শিক্ষায় বেশি মার্কা পাওয়ার অভিলাষী। কিন্তু হরপ্রসাদ ছিলেন সাধকের দলে এবং তাঁর ছিল দর্শনশক্তি।"

এই 'ভূয়োদর্শন' শব্দটার যথার্থ ইংরেজি প্রতিশব্দ আমি জানি না। আমি এই জিনিসটার পরিচয় শুধু যে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ফেরত মানুষের মধ্যেই পেয়েছি তা নয়, বরং অনেক বিপরীত অভিজ্ঞতাও হয়েছে। অনেক তথ্যের ভারে সে তার সংকীর্ণ মতকে প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে চলেছে, শীততাপনিয়ন্ত্রিত ঘরে অনেকবার দেখেছি। আবার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ানো, ভিক্ষার ঝুলি হাতে বাউলের মুখে, কি ক্ষেতে চাষ করতে করতে চাষীর মুখেও এমন কথা শুনেছি, তার মধ্যে জীবনের এক ভূয়োদর্শন পেয়েছি। ধন্য হয়েছি।

কিন্তু এই সংকীর্ণতার, আমি-সর্বস্ব দুনিয়ায় মরুভূমিতে আসা ছিঁটেফোঁটা বৃষ্টির মত সে ভূয়োদর্শন সে যুগেও বিরল ছিল, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, আজও বিরল।

গগন হরকরার গান শুনে ক্ষিতিমোহন সেন বাংলায় এসে শোনেন যে তিনি ততদিনে দেহ রেখেছেন। ক্ষিতিমোহন সেন লিখছেন কিভাবে গগন হরকরার একটা গান 'ডাকঘর' নাটককে প্রভাবিত করেছিল। 'ঘরে ঘরে বিলাই চিঠি - আমার চিঠি পাব কবে'। এখন রবীন্দ্রনাথের দর্শনে বাউলের দর্শনের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা অকারণ লেখাটাকে বড় করে ফেলা। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বহুবার বাউলের কাছে ঋণ স্বীকার করেছেন। বাউলের দর্শনে সেই ভূয়োদর্শনের আলোকে দেখেছেন বলেই তো।

আরেকজনের কথায় এসে শেষ করি, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রবন্ধ। একই কথা এখানেও। পাশ্চাত্যের কাব্য, দর্শন নিয়ে এমন রসসিক্ত বিদগ্ধ আলোচনার ক'টা বই পাওয়া যায় আমি জানি না। যেখানে তিনি লিখছেন, "মানুষের মেধা বা মনীষা সম্ভবত অতিজান্তব। কিন্তু এও মর্ত্যেরই মহিমা", সেখানে মনীষাকে আর এক ব্যাখ্যায় দেখা যায়। আমি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রসঙ্গ আনলাম, 'কুলায় ও কালপুরুষ' নামক আশ্চর্য গ্রন্থটির কথা আনলাম এই জন্যেই যে, আগের মতগুলি আস্তিকভাবাপন্ন, সুধীন্দ্রনাথ নাস্তিকভাবাপন্ন। কিন্তু মনীষার প্রতি শ্রদ্ধা, আনুগত্য ও উদারতা দুই ক্ষেত্রেই সমান। বার্ট্রান্ড রাসেল ও লালনের দেখা হলে দু'জনে মতে ভিন্ন হলেও, স্বীয় প্রকৃতির উদারতায় মনীষার জ্যোতিকে একে অন্যের মধ্যে দেখে শ্রদ্ধা করবেন এ অবশ্য সত্য। শিবনারায়ণ রায় মহাশয়ের লেখার সঙ্গে যারা পরিচিত তারাই অনুভব করবেন কথাটা কেন আমি সত্য বলে অনুভব করেছি, জেনেছি।

ধীশক্তি যখন নিজের মধ্যে নিজের আয়োজন সম্পূর্ণ করে দাঁড়ায়, তখন সে সব কিছুকে এক স্বাভাবিক সাম্যে দেখে। অসাম্যের কারণ আরেক অসাম্য নয়, কোনো এক চেষ্টার দ্রোহী হয়ে ওঠা। রবীন্দ্রনাথের গান, "নৃত্যের তালে তালে" এ সত্যের এক অসামান্য প্রকাশ।

রবীন্দ্রনাথের গায়ত্রী মন্ত্রের উচ্চারণে চোখে জল আসত। কারণ সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে চিত্তের মুক্তির সুরকে উনি ওঁর ওই কিশোর বয়সেই অনুভব করেছেন। যে মুক্তি ধীশক্তির আলোয় উজ্জ্বল। আনন্দিত। সার্থক। চিত্তলোকের যেন মহাবিশ্ব ভ্রমণ - এভাবেই রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেছেন।

মানুষের সমাজে দুই সত্য। ধী অনুভব আর যুক্তি দুইকে নিয়েই। ফরাসী বিপ্লবে তাই রুসো আর ভলতেয়ার, দু'জনেরই উজ্জ্বল উপস্থিতি। রুসোর সত্য অনুভবে, ভলতেয়ারের সত্য যুক্তিতে। বিরোধও হয়েছে। কিন্তু কেউ হারিয়ে যাননি। আমার ভয় হয়, আমরা না হারিয়ে যাই। মানুষ তার মানস সত্যকে সে তার প্রকৃতির ধাঁচ অনুযায়ী পায়। তারপর সেই প্রকৃতির সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে লাগে রুচি, শিক্ষা। এক চেষ্টা। যা উদার করে।

মাষ্টার মশায়কে রামকৃষ্ণদেব বলছেন, তুমি পরজন্ম মানো না মানো তাতে দোষ নেই, কিন্তু আমি যা জেনেছি সে-ই একমাত্র সত্য, এ ভাব ভালো না।

এই আধুনিক কথা। তর্কের মধ্যে আত্মপ্রতিষ্ঠা নয়, সত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস থাকুক। যুক্তির উদারতা থাকুক, ধারের সঙ্গে। সক্রেটিসের মত। যে উদারতায় বিষকেও বিষ বলে মনে হয় না অবশেষে।