Skip to main content

 

      চিঠি লেখা হয় না আজকাল ইত্যাদি কথা না। যে কথাটা রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রগুলো পড়তে পড়তে বারবার মনের কোণায় এসে দাঁড়ায়, প্রশ্ন করে, তা হল এই কথাগুলো চিঠিগুলো না লেখা হলে কলমের মুখ অবধি আদৌ কি আসত? ধরুন ছিন্নপত্র না, এমনিই অতি সাধারণ চিঠিপত্রগুলোর কথা, নানা জানা-অজানা মানুষকে চিঠি লিখেছেন তো অনেক। উনি নিজেও অবশ্য কোনো কোনো চিঠিপত্রে লিখছেন যে হয়ত তোমায় না লেখার হলে এই কথাগুলো আমি লিখতুমই না, তুমি তোমার যোগ্যতায় কথাগুলো আমায় দিয়ে লিখিয়ে নিলে...... এমন কথা অনেকবার লিখেছেন। তাই বলছি, এই কথাটা তো সত্যিই না, চিঠিতে যে কথা লেখার অবকাশ থাকে, সত্যিই কি আর কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থায় মনের এইরকম ধরণের কথাগুলোকে ছোঁয়া যায়?
      ‘এইরকম কথা’ বলতে আমি ঠিক কিরকম কথা বলছি? মনের অনেক চিন্তা আছে, ভাবনা আছে, অনুভব আছে, দুঃখ আছে যে কথাগুলো হাটের মধ্যে বলার নয়। কারণ তারা ঠিক কাজের কথা নয়। আমাদের হিসাবী মন আর নীতিবাগীশ মন যে কথাগুলোকে ঠিক আমল দেয় না, সেরকম কথাগুলোকে আমরা বলি কোথায়? বলা যেতে পারে - কেন গল্পচ্ছলে? হয় না তো। সামনাসামনি থেকে অনেক কথা বলা যায় না, যা একান্তে নিজের সামনে দাঁড়িয়ে লেখা যায়। যে কথাগুলো উচ্চারিত হয়ে হারিয়ে যাওয়ার নয়, যে কথাগুলোকে নিয়ে অবসরে নাড়াচাড়া করা যায়, সেই শব্দমালা থেকে আরো হয়ত নতুন মালা গাঁথা যায়। হোক সে বিনিসুতোর মালা। সে গান নয়, কবিতা নয়, ঘন ভাবাবেগ নয়, প্রবন্ধ নয়, উপদেশ নয়, হিসাব নয়, পরিকল্পনা নয়, পরনিন্দা নয়...সে শুধুই চিঠি। তার কোনো সমালোচক নেই, ব্যাকরণবিদ নেই, নিন্দুক নেই। আছে শুধু প্রাপকের আগ্রহজাগা দুটো হাত আর একটা সংবেদনশীল মন, যার দরজার ফাঁক দিয়ে গলে সে চিঠি তার কাছে পৌঁছালো।
      মা দিদাকে খুব চিঠি লিখতেন। যে সময়টা লিখতেন সে সময় আমাদের উপর নির্দেশ থাকত মাকে না ডাকার বা ঘরে কোনো শব্দ না করার। আমার সেই সময়ের মায়ের মুখটা দেখলে একটা অদ্ভুত আনন্দ বিস্ময় আর কষ্ট একসাথেই হত। আনন্দ, কারণ মাকে অতটা আত্মমগ্ন দেখা তো আর অন্য সময় যায় না, আর কষ্ট কারণ আমার থেকে যেন বড্ড দূরে, অচেনা মা। চিঠির শেষ কিছুটা জায়গা ছেড়ে রাখতেন আমার লেখার জন্য। নীল ইনল্যান্ড লেটারে মায়ের নীলকালিতে লেখা শব্দগুলো পড়ার চেষ্টা করতাম, অবশ্যই লুকিয়ে, বুঝতাম না, কষ্ট হত। আমার বরাদ্দ জায়গায় আমার কথা দিদাকে লিখতে বসতাম।
      আজ যদি মা ওই চিঠিগুলো না লিখতেন তবে কি সেই সব চিন্তাগুলো উনি আজ ফোনে জানাতেন? না হয়ত। কারণ আমাদের কথাবার্তার অভ্যাসটা মনের উপরের তলার বাসিন্দা। প্রয়োজনের দাসত্ব করতে করতে অনাবশ্যক কথা যদি সে বলে তবে সে কিছু ঠাট্টাতামাশা ইত্যাদি লঘুবাক্যবৃত্তি বই আর কি? চিঠি মনের গভীরের কথা লিখিয়ে নিতে পারে, চিঠির উদ্দিষ্ট মানুষটাও চিঠির গভীরতা বুঝে নিজেকে প্রস্তুত করেই সে চিঠি নিয়ে পড়তে বসে। তাতে অমর্যাদা হয় না।
      আজ একজন মানুষের চরিত্রহনন নিয়ে অনেক লেখা হচ্ছে। আমার ব্যক্তিগতভাবে বারবার মনে হয়েছে, খুব অস্বাভাবিক কিছু হচ্ছে? অমর্ত্য সেন, পণ্ডিত রবিশঙ্কর তো দূরের কথা, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও কি এমন চর্চার বই সাধু ভাষায়, ভালো মলাটে, দামী প্রকাশনী থেকে, নামী লেখকের গবেষণায় বেরোচ্ছে না? আমাদের সংস্কৃতির আধুনিকতম রূপ কি প্রতিদিনের ধারাবাহিকগুলোতে আমাদের উচ্চমার্গের রুচির পরিচয় দিচ্ছে না? আমরা কি কথায় কথায় বলছি না, যা চাপ পড়ার সময় নেই ভাই... রাতদিন তাই ফেসবুক পড়ি-করি, আর ওসব ক্লাসিক বই পড়তে গেলে মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যায়... ইত্যাদি ইত্যাদি... বাঙালি তো তাত্ত্বিক আলোচনা ভুলেই গেছে। তার সব আলোচনাই চাতুরীর, বৈষয়িক, রাজনৈতিক, কূটকাচালির, এবং অবশ্যই যেগুলোর মানও অত্যন্ত নিম্নমানের। বাঙালির মননের চর্চায় আজ দর্শন কই, মৌলিক ভাবনা? তথ্যের গবেষণা আর চিন্তার মন্থনে পার্থক্য থাকেই। সে আলোচনা থাক।
      আমাদের সব কিছু বড় তাৎক্ষণিকতার রোগে আক্রান্ত। তাৎক্ষণিকতার একটা নেশা আছে। হোয়াটস অ্যাপে নীলদাগ মানেই কাউণ্ট ডাউন, উত্তর...উত্তর...যে লিখছে আর যে পড়ছে দুজনেই চাপে। রিয়্যাক্ট করার। আমরা প্রতিক্রিয়া দিই, প্রতিক্রিয়াশীল হওয়ার প্রতিযোগিতায় নামি, ভাবি না। উত্তর খোঁজার চাইতে, উত্তর দেওয়ার তাগিদ অনেক বেশি আমাদের। কিন্তু এইটুকুই কি সম্বল আমাদের? না তো।
      আমি আজ অবধি কোনো মানুষের গভীরতম চিন্তার স্রোতে আবর্জনা দেখলাম না। চিন্তা যত কূল ছাপিয়ে মাঝনদীতে, তত সে স্বচ্ছ হতে শুরু করে। যত গভীরে সে যায়, তত পরিস্রুত সে। সে চিন্তায় হয়ত নির্বুদ্ধিতা আছে, ভুল বোঝাবুঝি আছে, অভিমানের চর পড়া শুকিয়ে আসা প্রবাহ আছে, কিন্তু মলিনতা নেই। বাইরে এর বিপরীত, সেখানে সে ভীষণ অগোছালো। সমস্ত তাড়াকে বাইরের দিকে রেখে মনের মধ্যে শুধু একটা অস্থিরতা আর উন্মাদনা বই যেন কিছুই নেই। যার বিপরীতে হতাশা, বিষাদ আর অবসন্নতা। প্রচণ্ড দৌড়াতে থাকলে মনের মধ্যে একটা ‘ফাইনাল ডে’ এর মোহ জন্মায়। আমরা যেন এমন একটা দিনের প্রত্যাশায় বাঁচতে থাকি যে দিনটা আমাদের সব স্বপ্ন সার্থক হবে, জ্ঞানে-অজ্ঞানে যা কিছু চাই, যা কিছু প্রত্যাশা, লোভ ইত্যাদি সেদিন যেন বাস্তব হবে। সব শত্রুনাশ হবে। আমার সেদিনের পর থেকে আর যেন কিচ্ছু চাওয়ার থাকবে না। প্রতিটা ইঁদুর দৌড় প্রতিযোগীর কল্পনায় এমন একটা দিনের স্বপ্ন আছে। যাকে নিয়ে তার উৎকন্ঠাও আছে। কোথাও তো সে জানে, সে মিথ্যা। পূর্ণতাকে অনুভব করার সম্ভাবনা আসলে প্রতিদিনের মধ্যে আছে, কিন্তু আমাদের প্রতিটা দিন পূর্ণ করে বাঁচার শিক্ষা হয়নি, অভ্যাস তৈরি করেনি। তাই সবার দৌড় প্রতিযোগীর কল্পনায় একটা লাল ফিতে আছে। কিছু উপহার আছে। এই তার দৌড়ের অনুপ্রেরণা।
      এই দৌড়ের জগতে তো চিঠি অবশ্যই বেমানান। তার ভাষা শ্লথ। তার উপরে কোনো সাবজেক্ট লেখার দায় নেই। তার ভাবনা শুধু ভাবনাই। তার দুঃখ শুধু দুঃখই। তার সে শুধু সে-ই। চিঠির বক্তব্য কিছু থাকে না, চিঠি শুধু বলে যায়। বলার জন্য বলে। তর্ক হতে পারে, ভাব বিনিময় হতে পারে। কিন্তু সে কোনো কিছুর তাড়ায় নেই। স্পিনোজা তার বন্ধুর চিঠি পেলেন, যা একটা তাত্ত্বিক প্রশ্ন নিয়ে। স্পিনোজার সেদিন এক শহর থেকে অন্য শহরে যাওয়ার দিন, সব তৈরি, উনি বেরোবেন। কিন্তু চিঠিটা পড়ে বুঝলেন, এখন বেরোলে এই চিঠির উত্তর দেওয়া হবে না, সে শহরে গেলে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। তাই তিনি দুদিন পিছিয়ে চিঠির উত্তর লিখতে বসলেন। আজ স্পিনোজার রচনাবলীর অংশ সেরকম নানা পত্রাবলী, আবার নির্বাচিত স্পিনোজার বইতেও, নির্বাচিত কয়েকটা চিঠির মধ্যে সে উক্ত চিঠি।
      পত্রসাহিত্য নেই, সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা মনের সে আগলগুলো খোলার আজ আর কোনো তাগিদ নেই। কারোর জন্যে কোনো ডাক আসে না। কারোর কিচ্ছু বলার নেই নির্জনে একটা সাদা কাগজকে। কোনো ডাকবাক্স এখন অপেক্ষা করে না কোনো উদ্বিগ্ন কাঁপাকাঁপা হাতে ফেলা কোনো চিঠির। সব বড্ড কাজের কথা চারদিকে। একটা গল্প বলে শেষ করি।
      আমার স্কুলে যাওয়ার পথে একটা ডাকবাক্স পড়ত। বেশ বড়, গম্ভীর মুখে যেন আমায় বলত, যা লিখেছ তা আমার আমার পেটের মধ্যে দিয়ে চলে যাও আমি সময় করে নিয়ে যাব। আমি প্রচুর চিঠি লিখতাম, বিশেষ করে আমার দিদাকে, কারণ তিনি তখন আমার ফ্রেণ্ড-ফিলোজফার-গাইড। একদিন হঠাৎ দেখি পোস্টবক্সটা নেই। বুকটা ধড়াস করে উঠল, তবে? কি করব এখন আমি? কোথায় চিঠি দিতে যাব? সেই তো লাইনের ওপার, মেলা দূর। দুরুদুরু বুকে পাশের চায়ের দোকানে জিজ্ঞাসা করলাম, হ্যাঁ কাকা, এই পোস্টবাক্সটা কই? কাকা উত্তর দিল না। পিসি বাসন মাজতে মাজতে বলল, উইড়ে গেছে।
      বোঝো, একটা কথা হল, উড়ে গেছে? তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। উড়ে যাওয়ার গল্পে বিশ্বাস করার প্রশ্নই নেই, কিন্তু আমার না লেখা চিঠিগুলোর কি হবে? বেশ কয়েকদিন হতাশ হয়ে, উদ্বিগ্ন চিত্তে স্কুল যাতায়াত করতে করতে হঠাৎ একদিন দেখলাম একই জায়গায় লাগানো ছোট্টো একটা পোস্টবক্স। সে যেন গম্ভীর নয়। তার কথা হল, বেশ আমি পড়ব না কি লিখেছ, তুমি দিয়ে যাও আমি অবশ্যই পৌঁছে দেব।
      কি করে, কি করে একদিন পোস্টবক্স খোঁজা বন্ধ হয়ে গেল মনে পড়ে না। কিন্তু না লেখা চিঠি যে জমেই যাচ্ছে, সে বুঝি। সে সব কথা কেউ বলে না আজকাল। সে কথারা ব্যস্ত দিনে সে অকাল বৃষ্টির মত। শুধুই আপদ, শুধুই বালাই।