Skip to main content

        আমি আজকের দিনে বুঝেছিলাম আমার ঘরের ভিতর যে আলো আসে, সে আলো এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আলোরই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটা আলো, সে বিশ্বজনীন। আমি আজকের দিনে বুঝেছিলাম, আমার বাগানে যে ফুলটা প্রতিদিন সকালে ফোটে সে বিশ্বজনীন, আন্তর্জাতিক নয়। আমি আজকের দিনে বুঝেছিলাম, আমার উঠোনে যে বাউল আসে, তার গলায় যে গান বাজে, তার একতারায় যে সুর ওঠে, তার আবেদন বিশ্বজনীন, আন্তর্জাতিক নয়। আমি আজকের দিনেই বুঝেছিলাম মানুষের মধ্যে আরেক মানুষ থাকে, সে বাউলের ভাষায় সোনার মানুষ, মনের মানুষ। সেই তাঁর লেখায় মহামানব, যে ‘মানব-অভ্যুদয়’ এর জয়ধ্বনির দিকে পথ চেয়ে বসে থাকে। সে আন্তর্জাতিক হওয়ার জন্য লোভাতুর নয়, তার শিরায় উপশিরায় মানবতার বাণী। মানবতার ডাক। সে ‘মানুষের ধর্ম’ এ আত্মপ্রকাশ ঘটায়। মানবতা – বিশ্বের কেন্দ্রে এক। 
        আমরা বিশ্বের একটা প্রাচীনতম সভ্যতা। তার ইতিহাসের বিচিত্র ধারা। সে ধারা শুধু রাজা-মহারাজের গল্প নয়। সে বিচিত্র দর্শন, বিশ্বাস, জীবনশৈলীর ইতিহাস। সেও আজকের দিনে জেনেছিলাম। জেনেছিলাম তিনি স্বর্গস্থ কোনো ঈশ্বরের খোঁজে ভারতের প্রাচীন ঋষি-মুনিদের কুটিরে যাননি। তিনি গিয়েছিলেন, মানুষের অন্তরে সেই গভীরতম মনুষ্যত্বের খোঁজে। যিনি অন্তর্যামী। যিনি আমায় ছেড়ে নন। যিনি আমার প্রেম-মঙ্গল-সত্য। তিনি একই সাথে সমগ্র মানবজাতির প্রেম-মঙ্গল-সত্য। তাঁকেই তিনি চেয়েছিলেন। কঠিনে, ত্যাগে, আত্মনিবেদনে। সে তপস্যাকে জীবনের তপস্যা বলেছিলেন। বৃহৎ সত্যকে গ্রহণ করার যোগ্য হতে বলেছিলেন, বৃহৎ ত্যাগে আর বৃহৎ দুঃখকে বরণ করে। জীবন যে ‘দহন-দান’ হতে পারে, সেও আজকের দিনেই জেনেছিলাম। 
        আজকের দিনেই জেনেছিলাম, মনুষ্যত্বর ভিত আত্মনিয়ন্ত্রণের জোরে। আত্ম-সংযম ব্যতীত মনুষ্যত্ব শুধুই কথার কথা। মিথ্যা অলঙ্কার। ভারতের দীর্ঘ পথে নানা বর্বরতা, ক্রুরতা, নিষ্ঠুরতা, ক্ষুদ্রতা এসে পথকে পঙ্কিল করে তুলেছে। তবু সে নিজেকে তার থেকে বার করে এনেছে মানবতার জোরে। বুদ্ধ, চৈতন্য, দাদু, কবীর, নানক, তুলসীদাস প্রমুখ আলোকোজ্জ্বল মানুষদের কথাও ওনার কাছেই জেনেছি। এমনকি রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মহাত্মার কথাও ওনার কাছে বসেই জেনেছি যারা ওর প্রায় কাছাকাছি কালেই বিচরণ করেছেন। তাঁরা কেউ কোনো অনুকরণের অজুহাতে, সস্তা বাইরের সাজ-সজ্জার পরিবর্তনে আমাদের আন্তর্জাতিক করে তোলার চেষ্টা করেননি। তাঁরা চেয়েছিলেন আমাদের মধ্যে মনুষ্যত্ব জাগুক। মনুষ্যত্ব জাগুক আত্ম-নিয়ন্ত্রণে। আত্ম-নিয়ন্ত্রণে সত্য দৃষ্টি জন্মায়। সত্য দৃষ্টি জন্মালে মানুষ মঙ্গলের পথ খুঁজে পায়। “শান্তং শিবম অদ্বৈতম” – তাঁর সারা জীবনের চিন্তা-বাক্য-কর্মের মূল ভিত্তি ছিল। যিনি নিজেকে আত্ম-নিয়ন্ত্রণে শান্ত করতে পেরেছেন, তিনিই সত্য দৃষ্টিতে মঙ্গলকে জেনেছেন। আর মঙ্গলেই সবের মধ্যে একের যোগসূত্র। তখনই সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠা পায়, শ্রী এসে বসে। আজ চারদিকে যে কোলাহল, যে তাড়া দেখলে হাসি পায়। জানি অবশেষে সব ব্যর্থ হবে। কারণ সত্যের কোনো তাড়া থাকে না। সে বলে না, আমার এখনই চাই। যে বলে আমার এখনই চাই, সে লোভ। তার তাড়া, আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার। নইলে তার মান থাকে না। সে মোহগ্রস্থ। এমন মোহগ্রস্থের দল সব যুগেই ছিল। তবে এদের কোলাহলটাই সম্বল। ধৈর্য, স্থৈর্য্য, আত্মত্যাগ – এই সবের মূল্য ফাঁকি আর শৌখিন অপুষ্ট উদারতায় ভোলাতে চায়। তাতে দুর্বল হৃদয়ে খানিক হুজুগের ঢেউ ওঠে বটে, কিন্তু শেষে সব অন্তঃসার শূন্যতায় পর্যবসিত হয়। সত্য বলে, তুমি সময় নাও, আমি অপেক্ষা করছি। তুমি নিজেকে পাও, অনুকরণে না, মনুষ্যত্বের দাবীতে। মনুষ্যত্বের একটাই আদেশ – প্রকাশিত হও। আত্মপ্রচার থেকে সরে এসো। বিশ্বের আঙিনায় নিজের মনুষ্যত্বের আনন্দে স্থির হয়ে দাঁড়াও। নিজের পোশাক, আচার, বিশ্বাস নিয়ে লজ্জিত হোয়ো না, সবল হও। মানুষের চিরকালের সাধন তার সংযম। তার মিথ্যাকে ত্যাগ করে আরো বেশি সত্যের নিকটাপন্ন হয়ে ওঠা। তুমি বাইরের চোখ ধাঁধানো ছলনা, বাগাড়াম্বরে ভুলো না। শান্ত হও, মঙ্গল-প্রেম আর সত্যে নিজেকে অভিষিক্ত করো। এই মানব-অভ্যুদয়। একে ফাঁকিতে চেও না। সে নিজেকে অপমান করা। 
        এসব আজকের দিনেই জেনেছিলাম।