সৌরভ ভট্টাচার্য
10 January 2016
চার্লস ডারউইন। তাঁর বিখ্যাত তত্ত্ব - অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম। অন্তঃপ্রজাতি,
আন্তঃপ্রজাতি এবং প্রকৃতির বিরুদ্ধে।
শেষের দুটো নিয়ে কিছু ভাবছি না। বিজ্ঞান সে পথে প্রভুত শক্তিশালী, আমাদের
সুরক্ষা-প্রাচীর। যদিও নিশ্ছিদ্র নয়। তবে সে আলোচনা থাক। আমার ভাবনার পরিধি অন্তঃপ্রজাতি
সংগ্রাম অবধি।
ইতিহাসে পড়লাম মানুষ নিরাপদে বাঁচার জন্য একসাথে থাকা আরম্ভ করল। শুরু হল সভ্যতার
প্রথম ধাপে পা দেওয়া। বেশ। মানুষ প্রথম কবে বুঝল সে নিজের প্রজাতির থেকেও নিরাপদ
নয়? ক্ষতি আসতে পারে, আঘাত আসতে পারে সেখান থেকেও? অর্থাৎ, প্রথম কবে সে উপলব্ধি
করল - অন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম?
সে বুঝল তার তীর-ধনুক, পাথর, লোহা ইত্যাদির লক্ষ্য শুধুমাত্র বন্য হিংস্র জীব না,
মানুষও। কবে তার অভিধানে প্রথম 'অসভ্য' কথাটা যোগ হল? কোনো ঐতিহাসিক জানেন না। তবে
সভ্যতার উন্মেষের সাথে সাথেই মানুষ বুঝল, এবার তাকে আরেকটা সংগ্রামের জন্য তৈরী
হতে হবে। সে বুঝল প্রকৃতি তাকে শিং, বিষদাঁত, বিষনখ ইত্যাদি কিছুই দিয়ে পাঠায়নি,
দিয়েছে বোধশক্তি। যার একদিকে যুক্তি আরেকদিকে অনুভূতি। সে বুঝল একসাথে থাকার
বিরুদ্ধে যে প্রবৃত্তি, তার বিরুদ্ধে একটা শক্তিকে দলবদ্ধ করতে হবে। তৈরী হল
সমাজনীতি। আসল সুর - অসুরের দ্বন্দ্ব। শুভ বুদ্ধি বনাম অশুভ বুদ্ধি।
সমাজনীতি। ক্ষুধা, যৌনতা, নিরাপত্তা - এই তিন প্রধান প্রবৃত্তি এর মূলভিত্তি।
এগুলোর তোষণকে সে নিশ্চিত করতে চাইল। কাজটা এত সরল নয়। মানুষের প্রবৃত্তি
ধারাবাহিক পথে চলে না। তার অনেক স্তর। অনেক ব্যাপ্তি। অনেক চোরাগোপ্তা খুপরি। তৈরী
হল ধর্মনীতি। কথা হল, সমাজনীতি বাঁধবে বাইরে থেকে, ধর্মনীতি বাঁধবে ভিতর থেকে।
গতিপথ তৈরী হবে। মুলধারার সাথে জন্মাল শাখা-প্রশাখা। তৈরী হল আইন। জন্ম নিল আইন
রক্ষাকর্তা। সে যুগে রাজা থেকে এ যুগে মন্ত্রী। প্রয়োজন এক, প্রকার আলাদা।
এ হল ইতিহাস। অন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম ও নীতির উদ্ভবের ইতিহাস। সে
ধর্মনীতি হোক চাই রাজনীতি।
এই নীতি শব্দটার কেন্দ্রে আরেকটা শব্দ আছে, সদর্থে। তা হল কৌশল। তাই Honesty is
the best Policy হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ কৌশল।
আমাদের এই উত্তরাধুনিক যুগে, দেহের আঘাত থেকে কৌশলের আঘাত তীব্র। এখন নীতিতে
নীতিতে টক্কর। এক কৌশলের কাছে আরেক কৌশলের হার মানা। নতুন শব্দ - কূটনীতি। অর্থাৎ
চোরাস্রোতে এক কৌশলকে আরেক কৌশলের ছদ্মবেশে হত্যা করা। কূটনীতি হল কৌশলের
ডুবোজাহাজ।
কপটতা, মিথ্যাচরণ - এই কৌশলেরই দুর্বল সংস্করণ। যে ব্যবহার করছে সেও সেই
অন্তঃপ্রজাতি সংগ্রামেই বাঁচতে চাইছে। কিন্তু পথটা সাময়িক বেছেছে। সে জানে তাকে
এক্ষুণি কিছু একটা করে এ সংগ্রামে জিততে হবে, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু
মুশকিল হল - "স্বার্থের সমাপ্তি অপঘাতে"। তাই এ কৌশল টিকল না।
তবে? মূলসুর যেখানে সাথ না দেয়, সেখানে বাকি কোনো সুর ধোপে টিকবে না। কোনটা সে
মূলসুর? সমাজ - সভ্যতা। একসাথে থাকার আদিম প্রবৃত্তি। অন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম তো
মন্থনজাত বিষ। সে বাদীসুর হিসাবে নেই। সে সমবাদী। তাই যে সমাজই, যে সভ্যতাই সেই
সুরটাকে মুল ভেবেছে, সেই মিথ্যা-কপটতা-লড়াইয়ে শেষ হয়ে গেছে। এতএব মূলসুর - "একসূত্রে
বাঁধিয়াছি "
আবার ডারউইনে ফিরি। তিনি বলছেন, এই সংগ্রামের ফলে একটা পরিবর্তন
আসে। তা যদি সাংগঠনিক হয় তবে টিকল, নয়তো অবলুপ্ত হল। দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গর
ক্ষেত্রে এ বলা খুব কঠিন কোন অঙ্গ থাকবে কোন অঙ্গ থাকবে না। প্রাকৃতিক নির্বাচনবাদ
এলো। অর্থাৎ প্রকৃতি ঠিক করবে।
আমাদের চিত্তবৃত্তির ক্ষেত্রে এটি নির্ধারণ করা কঠিন না, অনুসরণ করা কঠিন। তবু
তারও একটা ক্রমগতির পথ তৈরী হয়েছে। সেই বর্বর আদিম যুগ থেকে আজ অবধি সে ক্ষেত্রে
পরিবর্তনের একটা খসড়া দেখা যাক।
সামাজিক নীতি :
-----------------------------
১)সেই নীতিই গ্রাহ্য যা মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে হস্তক্ষেপ করবে না, যতক্ষণ
তা নিজের বা অন্যের ক্ষতির কারণ না হয়।
২) সেই সমাজনীতিই সার্থক যা আরো বেশি সহিষ্ণুতার অনুশীলন শেখায়, ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা
করতে শেখায়। তা ধর্মীয় হোক, কি আচার- বিচার- সংস্কৃতি বিষয়ক হোক।
যে যে সমাজ এ নীতি থেকে যত যত দূরে, সেখানে ক্ষোভ, গৃহযুদ্ধ তত তত
ব্যাপক, অনেক গভীর পর্যন্ত্য বিস্তৃত।
ধর্মনীতিঃ
---------------
আগের ক্ষুদ্র বোধ থেকে সে পরিবর্তনের মাধ্যমে বিশ্ববোধে এসে পৌঁছিয়েছে। বাইরের
নানান দেবতা এসে মিলেছেন অন্তর্যামীরূপী অনন্তের অনুভূতিতে।
যতক্ষণ না আমি বিশ্বব্যাপী একত্ব অনুভব করছি, মৈত্রী অনুভব করছি চিত্তে ততক্ষণ সব
ধর্মমতই ভ্রান্ত। বুড়োদের ছেলেখেলা। যার বলিদান আজও ঘটে চলেছে।
যে ধর্মের সাথে মুক্ত দর্শন বোধ নেই, সে চিরটাকাল এ বিশ্বের জন্য সামাজিক বোধের
জন্য ভয়াবহ। বুদ্ধ, খ্রীষ্ট, সক্রেটিস এরা সেই পূর্ণাঙ্গভাবে বিকশিত মানুষের এক
একটা নিদর্শন। অনুকরণে না, অনুসরণে এরাই ভবিষ্যতের কাণ্ডারী।
তবে অভিব্যক্তি শুধু অগ্রগামী না। মাঝেমধ্যে পশ্চাৎগামীও হয়ে ওঠে। একই ভুলের
পুনরাবৃত্তি করে - এ উদাহরণ ইতিহাসের পাতায় ভুরিভুরি।
তবে শেষ কথা, তাই সত্য, যা - বহুজন হিতায় বহুজন সুখায়।