গীতায় বলা হল হৃদয়ের দুর্বলতা ছেড়ে দাঁড়াও। আবার বলা হল হৃদয়ের মধ্যেই ঈশ্বরের অবস্থান। প্রথম কথাটা ব্যাসদেব প্রথমেই বললেন কৃষ্ণের বয়ানে। দ্বিতীয়টা একদম শেষে, সেও কৃষ্ণের বয়ানে।
এখন কথা হল একই হৃদয় দুর্বল আবার ঈশ্বরের অবস্থানে সবল হয় কি করে? তবে কি আমাদের দুটো করে হৃদয় আছে?
মনোবিজ্ঞানী বলবেন, আছে। একটা 'False Ego', আরেকটা 'True Ego'। একখানা 'কাঁচা আমি', একখানা 'পাকা আমি'। একখানা 'ছোটো আমি'। একখানা 'বড় আমি'।
এদ্দূর এসে জট পাকালো, তা দুটো আমির দরকার কি ছিল বাপু? একটা থাকলেই বা ক্ষতি কি ছিল? পশুপাখির তো এই সংকট নেই। যেমন ধরা যাক একটা গরুর কথা, যার নাম হল গিয়ে পটলা। এইবার তার ইচ্ছা হল কচি কচি ঘাস খাবে। কিন্তু আয়রনি হল সেই ঘাস জন্মেছে যার বাড়ির উঠানে সে বাড়ি তার মালিকের শত্রুপক্ষের। তার মনে কি আদৌ সঙ্কোচ হবে? হবে না।
আর একটা উদাহরণ ধরা যাক। পটলা নামক গরুটার, পেটে গোলমাল হয়েছে। এখন এদিকে মন টানছে কচি কচি ঘাসে মুখ ডুবিয়ে খায়। তার মধ্যে কি কোনো দ্বন্দ্ব আসবে? বা ভবিষ্যতে আরো পেট খারাপ হবে এমন আশঙ্কা করে সেকি পিছিয়ে আসবে? আসবে না।
কিন্তু এইবার ধরা যাক সেই পটলা নামক জীবটি অভিব্যক্তির নানা ধারা বেয়ে হল মানুষ। এইবার মানুষ হলে তার নানা সঙ্কট। নীতির সংকট, ধর্মের সংকট, বিবেকের সংকট। পৃথিবী জুড়ে এত এত মানুষের যে ইতিহাস লেখা হল, সে আদপে এই সংকটেরই তো গল্প। কে কোথায় কতটা অমানবিক হয়েছে, কে কোথায় কতটা মানবিক হয়েছে। এখানে 'মানবিক' শব্দটা আমি সদর্থে considerate মানুষের স্বভাবের কথা মাথায় রেখে বলছি।
মানে মানুষের এই যে ঝামেলা, এটা আছে, আর এটা করা উচিৎ বা হওয়া উচিৎ, যাকে হিউম মহাশয় is/ought -এর দ্বন্দ্ব আখ্যা দিয়েছেন।
বিষয়টা আরো তলিয়ে ভাবলে দেখুন আজকালের মনোবিজ্ঞান নানাভাবে দেখাচ্ছে যে মানুষ ফাঁকা সাদা ব্ল্যাকবোর্ড হয়ে জন্মায় না। তার মধ্যে আগে থেকেই থাকে জিন আর নিউরোনের গঠনের পূর্বশর্ত। তবেই হল। একজন সাইকোপ্যাথ যদি বলে আমার জেনুইনলি খুন করতে সাধ হয়েছিল ধর্মাবতার, মাইরি বলছি, কোনো মোটিভ ছিল না, আপনি বিশ্বাস করুন, এই যেমন আমার এখন সাধ হচ্ছে টুক্ করে গিয়ে আপনার গলার নলীটা কেটে দিয়ে, একটা টুলে বসে আপনার ছটফটিয়ে মরে যাওয়াটা দেখি একটা ডার্ক চকলেট চুষতে চুষতে।
দেখুন, মনোবিজ্ঞানী বলবেন, ইয়ে মানে লোকটি সত্য কথাই বলেছে। তাই বলে কি তাকে সমাজে ছেড়ে দেওয়া হবে? হবে না। তার মত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাই কিনা? এরকম আমাদের অনেক খারাপ কাজের অনেক মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, যেখানে বোঝা যায় ঘটনাটা ঘটানো সম্পূর্ণ আমার ইচ্ছাধীন ছিল না। এটা হল হিউমের ভাষায় 'is', মানে বর্তমান, আর সমাজতত্ত্বের ভাষায়, 'fact'। কিন্তু গপ্পো কি আর এইখানেই শেষ দাদা? হিউম বলবেন, তবে 'is' এই সব ডামাডোলের হলেও, ওসব করা কি উচিৎ? এই এলো ওনার ভাষায় 'ought' বা ঔচিত্যবোধের সংকট। তখন সমাজ বিজ্ঞানী বলবেন, বটেই তো, যতই এইটা মনোবিজ্ঞানের fact হোক না কেন, এই স্বভাবের 'value' কি? দেখলেন, সেই হিউমের সংকটকেই সমাজবিদেরা নিজের ভাষায় কেমন 'fact/value' দ্বন্দ্ব করে নিয়েছে।
এখন এই মূল্যবোধ, ঔচিত্যবোধের আলোচনা চলেছে বিশ্বজুড়ে। যা হোক কেউ না মেনে চললেও একটা হিউম্যান রাইটস্ বা মানবাধিকার তত্ত্ব গড়ে তোলা গেছে। অন্তত বড় অংশে একটা সিদ্ধান্তে আসা গেছে। যদিও সে নিয়ে অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনও আমাদের অজানা। মুশকিল হল গিয়ে কগনিটিভ সায়েন্স যত এগিয়ে যাচ্ছে, তত আমাদের আধুনিক যুগের অনেক তত্ত্ব খালাস হয়ে যাচ্ছে। আবার নতুন করে ভাবাচ্ছে সব।
তবে কি ধর্মের একটা দিক মানুষের এই is/ought -এর দ্বন্দ্বের সমাধান একটা প্যারালাল ওয়ার্ল্ড বানিয়ে করতে চেয়েছে। যেখানে ঈশ্বর একজন সম্পূর্ণ ঔচিত্যবোধের পরাকাষ্ঠার মানবিক বা ধারণার রূপ। আর is বা যা আছে সে হল আমাদের এই দোষেগুণে ভরা জগত সংসারের রূপ। এই কি তবে মোদ্দা দর্শন? আমি ধর্মের থিওলজিকাল দিকটা বলছি। সমাজে তার কুফল বা সুফল নিয়ে আলোচনায় যাচ্ছি না। মানুষের মনের, জ্ঞানের তথা বোধের যে ক্রমবিকাশ ঘটে চলেছে আমি সেই ক্রমবিকাশের একটা অংশকে প্রশ্ন করতে চাইছি। আমি এও বলতে চাইছি না যে সেই সমান্তরাল বা প্যারালাল জগতের তত্ত্বটা বা থিওলজিগুলো সম্পূর্ণ নির্ভুল। আমি তাদের চেষ্টার বৈশিষ্ট্য বলতে চাইছি।
মানুষের এই সংকট অনন্তকাল ধরে চলবে। আজকে বিজ্ঞান যে সব পরীক্ষানিরীক্ষা করতে চাইছে তার সব ফল নিশ্চয়ই মঙ্গলজনক হবে না। আমাদের সময়েও তাই এই is/ought -এর দ্বন্দ্বে আমাদের মত করেই উত্তর খুঁজতে হবে। is -টা সব সময়েই অবজেক্টিভ। ought -টা সব সময়েই সাব্জেক্টিভ। তাই নানা মত জন্মাবেই। এর মধ্যে থেকে "সকল দ্বন্দ্ব বিরোধ মাঝে জাগ্রত যে ভালো" তাকে খুঁজে পেতেও হবে। সেই চেষ্টাটা চালিয়ে যাওয়াই তো মানবিক সাধনা।
যে কথাটা দিয়ে শুরু করেছিলাম। একই হৃদয় কি করে দুর্বল আবার সবল হয়? গীতায় ব্যাসদেব বলছেন, মোহ থেকে। মোহ মানেই মিথ্যাকে সত্য বলে জানা। fact আর value -র দ্বন্দ্বও সেই। fact, information এর সুনামি যেন আমাদের মোহগ্রস্ত করে না তোলে। আমাদের অবশেষে দরকার নির্মোহ হয়ে মঙ্গলের রাস্তাটা একসঙ্গে খোঁজার। এবং তা অবশ্যই শুভবুদ্ধির আলোতে। শুভবুদ্ধি মানেই হল গিয়ে সেই পাকা আমি বা বড় আমি।