"এখনকার ছেলেমেয়েরা স্যারেদের আগের দিনের মত সম্মান করে না। আগে হাজার মারধর করো মুখে 'টুঁ' শব্দ করত না। আগেকার দিনে পড়াশোনাও অনেক ভালো ছিল এখনকার থেকে। এখনকার মত এত নোটস মুখস্থ, টিউশান পড়ার ধুম ছিল না। স্যারেরাও স্কুলে খুব ভালো পড়াতেন। ওতেই সব হয়ে যেত।"
উপরের কথাগুলো শুনে বড় হননি এমন বাঙালী মেলা ভার। কথাগুলো আংশিক সত্য তো বটেই। একটা কথা বাজারে আছে, আধুনিক বাজারে, 'Knowledge Transfer'. এখন কথা হচ্ছে, এই তথ্য স্থানান্তরণের সাথে শিক্ষা দেওয়ার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই আজকের শিক্ষা পদ্ধতিতে। আমি অনেক তথ্য জানি, তুমি এসো তোমার মাথায় ঢুকিয়ে দিই। আমার এই তথ্য ঢোকানোর কৌশল যত সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম হবে, আমার দক্ষিণাটাও ততটা ভারী থেকে ভারীতর হবে।
এই শিক্ষা স্থানান্তরণের পদ্ধতিটির ভাবটা আমাদের সমাজে এখনো খুব একটা সড়গড় নয়। যদিও খুব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। তাই এখনো দেখেছি অনেক অভিভাবক তথা ছাত্রছাত্রী টাকাপয়সার কথা সরাসরি বলতে একটু সংকোচ বোধ করেন। বেশিদিন এ সঙ্কোচ থাকবে না অবশ্য। এর একটা বড় কারণ হল, আমাদের সেই প্রাচীন ‘জ্ঞানদান’ ধারণা। অর্থাৎ বিদ্যা দান করা যেতে পারে, কিন্তু কখনোই বিক্রি করা যাবে না। অস্বীকার করার উপায় নেই এটা সত্যিই অত্যন্ত উচ্চ আদর্শ। কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এ ভাব বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে উঠছে। তাই এখন জ্ঞান তথা তথ্য তথা কৌশল বিক্রির যুগ। আর সব কিছুর মত এটাও একটা বস্তু। এও ব্যবসার কাঁচামাল। পুঁজি। তাই এখন সেই জ্ঞান তথা তথ্য তথা কৌশল বিক্রেতা, কোনো অতিরিক্ত মান-সম্মান আশা করে বসলে সেটা নিতান্তই অতিরিক্ত চাওয়া। ক্রেতা বলে বসলেন বলে, 'কেন বাপু, ন্যায্যমূল্য কি ধরে দিইনি? আপনার কথা অনুযায়ী অগ্রিমও তো দিয়েছি (একটা কথা মনে থাকতে থাকতে এখানে সেরে রাখি, সেই পুরাতন যুগের ধ্যানধারণায় চলা শিক্ষকও যে নেই তা নয়, তাঁরা এখনও আছেন; আর ‘আমায় সম্মান করো’ বলে নাকীকান্না জুড়ে ঘুরে বেড়ানোর দলে কোনোদিন নেই তাঁরা। তাঁদের সময় কোথায়? একদলকে তৈরি করে রণাঙ্গণে পাঠাতে পাঠাতেই যে আরেকদল এসে হাজির তাঁদের দোরগোড়ায়।)!'
এ তো গেল শিক্ষকের পদের স্থানান্তরণ। আরেকটা সমস্যা ক্রমশঃ জটিল হয়ে উঠছে – 'Burden Of Knowledge' - জ্ঞানের বোঝা। যতটা জানলে কাজ চলে যায় তার চাইতে বেশি জানাটা ক্ষতিকারক না লাভদায়ক? আপাতদৃষ্টিতে লাভদায়ক হলেও আগাম একটা বিপদের বার্তা সে নিয়ে আসছে। দেখা যাচ্ছে, বেশি জ্ঞানের বা তথ্যের ভারে তার স্বাভাবিক চিন্তা করার বা তার মধ্যের Intution বা স্বজ্ঞার তীক্ষ্ণতা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। যখনই কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়ছে, সে তার Ready-made Database হাতড়াচ্ছে। সেখানে কোনো সাহায্য না পেলে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে, কি করে এই আসন্ন বিপদ থেকে উদ্ধার পাবে! ইন্টারনেটে বসছে, নানান জনের নানান অভিজ্ঞতার তথ্যের জঙ্গলের মধ্যে ঢুকছে। দরকাঁচা কোনো উত্তর পাচ্ছে, তাকেই সে চরম সত্যি বলে মেনে নিয়ে বাস্তব জগতে কাজে লাগাতে যাচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হচ্ছে। আবার ইন্টারনেট ঘাঁটা। আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। লেগে গেল তো ভালো, না হলে সংকর অবস্থায় সঙ্কটাপন্ন থাকা।
এর প্রধান কারণ, তাকে যুক্তিপূর্ণ চিন্তা করতে শেখানো হয়নি ছোটোবেলা থেকে। তাকে ভুল করার খুব একটা অবকাশ দেওয়া হয়নি। যে সবসময় অন্যের জ্ঞানের ভাঁড়ারঘরে অনায়াস যাতায়াতের সুযোগ পেয়েছে অর্থবলের বিনিময়ে, সে কেন খামোখা খেটে মরবে নিজের ভাঁড়ার ঘর তৈরি করার জন্য?
একেই বলা হচ্ছে 'জ্ঞানের বোঝা' বা 'জ্ঞানের বাধা'। কারণ আহৃত জ্ঞান মানেই অতীতের তথ্য সঙ্কলন। যে সবসময় সেই মৃত তথ্যের উপর চলাফেরা করতে অভ্যস্ত হবে তার ক্ষেত্রে জীবন মানেই একটা চূড়ান্ত নিরাপত্তায় ঘেরা আবাসন হবে। সব কিছুর মধ্যেই চরম নিশ্চিন্ততা খোঁজাটা দুর্বলতার অলসতার লক্ষণ। আর মানুষের সবচাইতে অলস যন্ত্রগুলোর মধ্যে একটা হল তার মস্তিষ্ক। সে যদি না খেটে, শুধু অন্যের ধনে ভাগ বসিয়ে চালিয়ে নিতে পারে তবে কেন আর লড়তে যাবে বেকার বেকার?
তার অন্তঃকরণের এই চূড়ান্ত পঙ্গুত্বকে, এই পরনির্ভরশীলতাকে সে স্বাধীনতা নাম দিয়ে বসছে। কারণ এখন স্বাধীনতার একটা সহজলভ্য সমার্থক শব্দ হচ্ছে, 'ক্রয়ক্ষমতার পরিমাপ'। একটু ভাবলেই এর অসারতা দৃশ্যমান, তাই এই নিয়ে আর কথা বাড়ানো নিষ্প্রয়োজন।
এর উল্টোটা যদি অভ্যেস করানো যেত? যদি তাকে লাইফবোটের জোগান না দিয়ে সাঁতার শেখানো হত ছোটোবেলা থেকে? তবে তো আর সে ‘বিদ্যাবোঝাই বাবুমশাই’ হত না? সে মননের গভীরতায় ডুব দিতে পারত। আরো বেশী আত্মবিশ্বাসী, আরো বেশি নিজের কাছে নিজে সৎ হতে শিখতে পারতো। আমার মনে হয়, জগতে আরো নানান কাজের দিক তৈরি হত। কারণ, যে যার রুচি অনুযায়ী জীবনধারণ করার স্বাধীনতাকে স্বাধীনতা বলত। দিনের শেষে সে আর টাকার অঙ্কে নিজের সফলতা বিচার করত না, করত নিজের আত্মপ্রসাদে, যেটা সে নিজের কাজের মাধ্যমে পেয়েছে।
আর ঠিক সেই দিন সে সঠিক অর্থে 'শিক্ষক দিবস' পালন করতে পারত। সে বুঝতে পারত, যে দামী লাইফবোট যুগিয়েছে সে তার সেদিনের সত্যিকারের সুহৃদ ছিল না, যে বারবার তাকে মাঝনদীতে ঠেলে দিয়েছে, সাঁতার কাটার উৎসাহ যুগিয়েছে, সেই-ই তার সত্যিকারের শিক্ষক ছিল, আছে, থাকবে।
ঠিক তাই 'তোতাকাহিনী'র লেখককে আজও এত বেশি করে দরকার হয়, সব কম্পিউটার Shut Down হয়ে যাওয়ার পর। সাঁতার শেখা বাকি আছে যে এখনো।