জানো কিনা জানি না। আমি অনেক বাড়ি দেখেছি, যারা কেউ হাসে না। তারা যে দুঃখী তা নয়। তারা হাসার কোনো কারণ খুঁজে পায় না। চোখের উপর তাদের কোনো পর্দা নেই আর। ধুলো-বালি-খড়কুটো সব গিয়ে চোখে পড়ছে, কিন্তু তবু তাদের চোখ জ্বালা করছে না, আমি এমন দেখেছি। তাদের চোখের সামনে টিভিতে কতলোক হাসছে-কাঁদছে-গল্প করছে-নাচছে-গাইছে। তারা স্থির হয়ে টিভির সামনে বসে। কত দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, মানবিক বিপর্যয় দেখাচ্ছে - তাদের মুখের পেশীগুলো স্টেশানের নামের অক্ষরের মত নিশ্চুপ। ট্রেনের যাতায়াতে তাদের কিচ্ছু আসে যায় না। ট্রেনের দরজা দিয়ে নেমে কেউ বলছে, এই তো সেই স্টেশান, এখানেই তো আসার ছিল। স্টেশানের নামের হলুদ পাটাতনে লেখা, কালো অক্ষরেরা চুপ। কেউ বলছে, এটা তো নয় আমার স্টেশান। তবু অক্ষরেরা চুপ। বৃষ্টি-ঝড়-অসহ্য তাপ- কনকনে ঠাণ্ডা - প্ল্যাটফর্মের স্থান পরিচায়ক শব্দ চুপ। সে যেন ভুলেই গেছে তার অস্তিত্ব মুছে যায়নি এখনও। সে যেন ভুলেই গেছে তাকে দেখে গন্তব্য নির্ধারণ করে এখনও অনেকে। সে যেন ভুলেই গেছে পৃথিবীটা ঘুরছে এখনও, বাতাসে এখনও তার শ্বাস নেওয়ার মত অনেক অক্সিজেন আছে। অফুরান খাদ্যও আছে। তার মলমুত্র ধারণ করার ভাগাড়ে স্থানাভাব লক্ষকোটি বছরেও হবে না, তার একার মত।
আসলে এরা পরিত্যক্ত। এদের ভালোবাসা ছেড়ে গেছে। এরাও আর ভালোবাসায় বিশ্বাস করে না তেমন আগের মত। তবু পায়ে সুড়সুড়ি দিলে যেমন শরীরের ভিতরটা রি-রি করে ওঠে, এদের তেমনই অন্যের ভালোবাসা দেখলে মনের ভিতরটা ওরকম করে ওঠে। ওরা সামলে নেয়। মৃত্যু ছাড়া ওদের প্রতীক্ষায় তেমন আগ্রহ নিয়ে কেউ বসে নেই আর। ওরাও মৃত্যুর সাথে, এই আলোকময় জগতের সাথে পাষাণ প্রাচীর তোলার সাজসরঞ্জাম জোগাড় করে নিয়েই বসে আছে। ওরা হাসে না। ওদের বয়সের ভারের চেয়ে মনের ভার অনেক বেশি। ওরা আমাদের নগর-দুরন্ত-গতিমান সভ্যতার গারবেজ। লিক টায়ার। পুরোনো ফুলে ওঠা ব্যাটারি। পুরোনো এডিশানের ওএস। নরদমার মুখে জমে থাকা নোংরা, বেরোলেই স্রোত ফিরবে।
ওদের চোখের উপর চোখ রেখে আমার হৃদয় স্তিমিত হয়ে আসে। আগাম স্টেশানের ঘোষণা শুনতে পাই। শুধু প্ল্যাটফর্ম কোন দিকে পড়বে বুঝতে পারি না।
সৌরভ ভট্টাচার্য
10 May 2018