ঘটনাটা মর্মান্তিক। কিন্তু অস্বাভাবিক নয়।
ছেলেটা গ্র্যাজুয়েশান পাস করল। অতি সাধারণ পরিবার থেকে আসছে। একটা নাম করা কোম্পানিতে যোগ দিল কাজে। ওরা বলল, আমরা যতদিন ট্রেনিং দেব ততদিন মাইনে দেব না। খাওয়া-পরা দেব।
তার সেই মুহূর্তে কোনো অপশান নেই আর। সে জয়েন করল। হাড়ভাঙা খাটুনি। তার মা একমাস পর দেখতে গেল। তার জন্মদিন সেদিন। ছেলের চেহারা দেখে চমকে উঠল। কিন্তু উপায় কই? বাবা নেই, নিজের পায়ে যত তাড়াতাড়ি হোক দাঁড়াতে তো হবেই। সবাই তো আর অত মেধাবী হয় না যে মাধ্যমিক, কি উচ্চমাধ্যমিক রেজাল্ট বেরোনোর পরের দিনই কাগজ জুড়ে তার ফিল্মি ভাষায় জয়যাত্রার গল্প লেখা হবে…. বাবা রিকশা চালায়, মেয়ে মাধ্যমিকে ৯৯% নাম্বার। তার দু'চোখ জুড়ে ডাক্তার হবার স্বপ্ন। সে স্বপ্ন পূরণ হবে? আসুন শুনে নিই তার মুখ থেকেই…. তার আত্মীয়স্বজনের মুখ থেকে… ইত্যাদি ইত্যাদি।
দু'রকম সত্য হয়। এক ভিজিবল ট্রুথ। আর এক রিয়েল ট্রুথ। রেজাল্ট বেরোনোর পর ওই সব গরীবঘরের মেধাবীরাই হয়ে যায় ভিজিবল ট্রুথ। বাকিটা? কে শুনবে সে গল্প?
যা হোক, ছেলেটা দাঁতে দাঁত চিপে কাজ করে যায়। এভাবে ও বড় হয়নি। যতই অতি-সাধারণ ঘরে জন্মাক, দাদু-দিদা-মায়ের আদরযত্নেই তো বড় হয়েছে। অবশ্যই তাতে গোটা জীবন কাটে না। কিন্তু এখানে যা হচ্ছে? না খাওয়ার সময়ের ঠিক, না খাবারে মানের ঠিকঠাক কিছু, না কোনো হেলথ্ স্কিম, না কোনো সিকিউরিটি স্কিম। কি হচ্ছে? কিন্তু বলেছে ওরা যে কয়েকমাস টিকে গেলেই কোম্পানি নিয়ে নেবে।
হঠাৎ একদিন রাতে ফোন এলো। মা আমাদের অমুক রাজ্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ক'দিনের মধ্যেই।
বাড়ি আসবি না?
জানি না। তুমি কিছু জামাপ্যান্ট আমায় দিয়ে যেও।
মা আবার গেল। বুকে পাথর রেখে ছেলের সঙ্গে দেখা করল। ছেলে দু'দিন পরে ট্রেনের আনরিজার্ভ কম্পার্টমেন্টে উঠে বসল আরো অনেকের সঙ্গে। গন্তব্য, পশ্চিমবাংলার একদম অন্যদিকে আরেক রাজ্য।
এও ট্রেনিং-এর অংশ। এখানেও মাইনে নেই। এখানেও কোনো হেলথ্ স্কিম নেই, কোনো সিকিউরিটি স্কিম নেই। কাজ করে যাও।
মাঝে মাঝে খবর পায় মা। একদিন শুনল তাদের এবার জয়েনিং দেবে, গন্তব্য জানিয়ে দেওয়া হবে।
ক'দিন বাদে মা খবর পেল ছেলে আরো অনেকের সঙ্গে উঠেছে আবার এক দূরপাল্লার আনরিজার্ভ বগিতে। গন্তব্য দক্ষিণের এক রাজ্য।
তাদের নিয়ে যাওয়া হল পাণ্ডববর্জিত এক গ্রামে। সেখানে কাজ, রাস্তা বানানো। খাবার তো দূর, খাবার জলের অবধি কোনো সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেই।
সে সেখানকার ভাষা বোঝে না। খাবার-শোয়ার ঠিকঠাক ব্যবস্থা নেই। রোজ সকালে ট্রাক আসবে, তাদের নিয়ে যাবে কাজের জায়গায়, আবার এই গ্রামে ফিরিয়ে দিয়ে যাবে।
কিন্তু এতদিন তো ওই নামী কোম্পানির লোগোওয়ালা টুপি ইত্যাদি দেওয়া হত, ওরা কই?
জানিয়ে দেওয়া হল, এই জয়েনিং হয়েছিল থার্ডপার্টি থেকে। ওই কোম্পানির এখন লাগবে না। তাই তাদের মালিক এখানে এনে ফেলেছে। আপাতত মাইনে নেই। বড় বড় অনেক কোম্পানি এইভাবে থার্ডপার্টি দিয়ে লোক নিয়ে কাজ চালিয়ে নেয়।
সে টিকতে পারল না। মা এখান থেকে তৎকালে টিকিট করে দিল। সে ফিরে এলো। অনেকেরই অবশ্য এই ফেরার চিন্তাটাও বিলাসিতা।
ধুরন্ধর তার্কিক বলবে, তার তো আগেই খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল। তাদের আমার একটাই কথা বলার, এই ধরণের উচিত ভাবার সময় সবার সবসময় থাকে না। এই গেল এক নম্বর। আর দুই, নানারকম স্ক্যামে কত ধুরন্ধর লোক আজকাল ফাঁসছে সে তো পেপার খুললেই দেখা যায়। যার জন্য সরকারকে ভাবতে হচ্ছে যে বেশি টাকার অঙ্ক পাঠাতে গেলে চারঘন্টা একটা উইন্ডো পিরিয়ড রাখা হবে।
যে ছেলেটা ফিরে এলো, এইভাবেই সে ফিরে এলো, পরিযায়ী শ্রমিক হতে হতে ফিরে এলো। কিন্তু এটা-একটা গল্পের একদিক মাত্র।
লকডাউনের সময় পরিযায়ী শ্রমিকদের কি অবস্থা হয়েছিল সে অনেকেরই হয় তো স্মৃতিতে থাকবে। যদিও সে স্মৃতি ম্লান হতে বেশি সময় লাগেনি আমাদের। জীবন তো নদী। আমরা সে নদীতে বড় বড় জাহাজের চাকচিক্য দেখব, নাকি ডিঙির ডোবা ভাসা দেখব?
পরিযায়ী শ্রমিক সারা ভারতে কোথায় কত পরিমান যায়, কোথাও কারোর কাছে কোনো সঠিক ডেটা ছিল না। এখনও আছে বলে মনে হয় না। হাওড়া-শিয়ালদায় গেলে দূরপাল্লার ট্রেনে আনরিজার্ভ বগির সামনে সে বিশাল লাইন থাকে, যাদের উপর বিরক্ত হয়ে, ঠেলে গুঁতিয়ে নিজেদের উচ্চশ্রেণির ক্লাসের দিকে যেতে হয় তাদের অনেকেই এই শ্রেণীর। একবার মনে আছে জ্বরে বেঁহুশ এক ছেলে ট্রেনে পড়ে আছে, সে ব্যাঙ্গালোরে যাচ্ছে কাজে, প্রায় আট-দশ ঘন্টা হয়ে গেল কোনো সহযাত্রীর কোনোরকম কোন হুঁশ নেই। একটা প্যারাসিটামল দেওয়ার মানুষও নেই।
এরকম বহু বহু অভিজ্ঞতা সবার আছে। ক্রিকেট আর সিনেমা অবসেসড্ একটা দেশের কাছে সবটাই যতক্ষণ না একটা রোমহষর্ক নাটকীয়তায় রূপ নিচ্ছে ততক্ষণ সাধারণ পাব্লিক এটাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস বলে মনেও করে না। অনেক তথাকথিত শ্রমজীবী রাজনৈতিক ভাবাদর্শ মানুষ আবার এই ফাঁকে ধর্ম ইত্যাদি নিয়েও তার ব্যঙ্গবিদ্রূপ করার সুযোগটা হাতছাড়া করতে চান না। কারণ টানেলের সঙ্গে চারধাম শব্দটা জুড়ে আছে।
পরিযায়ী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, সুরক্ষা, সঠিক স্ট্যাটেসটিকস ইত্যাদি নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবার কথা এখনও আমাদের অভ্যাসে দাঁড়ায়নি। নইলে সত্তর ঘন্টা কেন, আশি-নব্বই ঘণ্টা কাজ করেও নিজের পরিবার চালাতেই হিমশিম খাওয়া মানুষ কি করে উজ্জ্বল দেশ গড়ার কথা ভাববে আমার জানা নেই।
আজ সুড়ঙ্গবন্দী শ্রমিকদের নিয়ে হঠাৎ করে যে আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়েছে, সে মিডিয়ার কাজ। সে আমাদের সত্যকারের ছবি নয়। আমাদের সত্যকারের ছবি যদি একবার সামনে আসে তবে আমাদের নিজেদেরই নিজেদের দিকে তাকাতে লজ্জা করবে। অনেক ছবি এড়িয়ে আমরা ভালো আছি। অনেক সত্যকে অস্বীকার করে আমরা সুস্থ আছি। সেসব সামনে না আসাই ভালো। সমাজের সেসব দিক নিয়ে আলোচনা করা নিতান্ত শৌখিনতা আমার কাছে, যদি না সে মানুষদের সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগের ব্যবস্থা করি নিজের চিত্তে। নইলে শুধু টি-আর-পি বাড়ানোর জন্য সুড়ঙ্গবন্দী বাড়ির লোকদের দুশ্চিন্তার ছবি, মুখ, কান্না ইত্যাদির মশলা তো আছেই। অনেকের তো অনেক বাড়ির লোকের মুখ নাকি চেনাও হয়ে গেছে। রোজ দেখা হয় যে। কিন্তু কেন? কারণ এটাই আমার কাছে জ্বলন্ত ইভেন্ট একটা। আবেগটা অসৎ বলছি না। বড্ড অগভীর আর তাৎক্ষণিক।