Skip to main content

 

011.jpg

মনুষ্যজাতির প্রতি প্রেম নিয়ে কোনো রোম্যান্টিসিজম রামকৃষ্ণদেবের ছিল না। সংহতি, সম্প্রীতি, সমন্বয়ের প্রতি অনুরাগ ছিল, কিন্তু “মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ” - এ মতে বিশ্বাসী ছিলেন না।

সব মানুষ কি বিশ্বাসযোগ্য?

রামকৃষ্ণদেবের দর্শনে, না। সব জল পানযোগ্য নয়। বাঘের মধ্যেও নারায়ণ আছে, তাই বলে বাঘকে আলিঙ্গন করা যায় না।

বেদান্তদর্শন অনুযায়ী অস্তিত্বের প্রতিটা কণা সচ্চিদানন্দের প্রকাশ। কিন্তু সে তো তত্ত্ব। বাস্তব?

এইখানে রামকৃষ্ণদেবের দর্শন বলে, তুমি যাকে বাস্তব বলছ, ওটা লীলা।

লীলা মানে কী? মানে হল যা ঘটছে। কিন্তু কোনো উদ্দেশ্য মাথায় রেখে ঘটছে না। কাম্যু এককালে জগতকে অ্যাবসার্ডিজম তত্ত্বে দাঁড় করিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ যা কিছুই ঘটে তা স্পষ্ট বোঝা যায় না। রামকৃষ্ণদেব কাম্যুর গালটা টিপে দিয়ে বলবেন, এ মায়ার জগত, এটির পর উটি হবে, এখানে অত নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। এটা তুমি ঠিক বুঝেছ। ভীষ্মও মৃত্যুর আগে শরশয্যায় শুয়ে কেঁদেছিলেন। কারণ জিজ্ঞাসা করা হল, মশায় কেন কাঁদছেন, আপনি তো জ্ঞানী।

তখন ভীষ্ম হাতজোড় করে কৃষ্ণের দিকে ফিরে বলেছিলেন, এত এত বিদ্যায় পারঙ্গম হলাম, কিন্তু তোমার কার্য কিছুই বুঝতে পারলাম না। যে তুমি পাণ্ডবদের এত সহায়, তাদেরই বিপদের অন্ত নেই।

শ্রীগোবিন্দ হেসেছিলেন।

======

শ্রীরামকৃষ্ণ জানতেন, মানুষ একটা ভয়ংকর জীব। তার মধ্যে এক অসম্ভব বিধ্বংসী ক্ষমতা লুকিয়ে আছে।

একটা মামুলি চকোলেট বোম মানুষ কত সাবধানে ফাটায়, একটা গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে মানুষ কত সতর্ক থাকে। কিন্তু সে সবের থেকে লক্ষগুণ ভয়ংকর মানুষ। চাইলে সে কী না করতে পারে। বর্তমানে বাংলা সাক্ষী। কী ভীষণ পণ্ডিত মানুষেরা কী ভয়ংকর হতে পারে। কিন্তু সেই মানুষকে নিয়ে মানুষের ভাবনা কত কম। কী জানছি সেটাই বড় বিষয়, কে জানছে, তার দিকে তাকিয়ে দেখার সময় নেই।

রামকৃষ্ণদেব সেটার দিকে তাকাতে বলেছিলেন। বলেছিলেন, ওহে তোমরা কী কী জানছ সে নিয়ে আমার তেমন আগ্রহ নেই, কিন্তু কে জানছে সে খেয়াল রাখছ তো? শুদ্ধখাঁটি দুধ রসুনের বাটিতে রাখছ না তো? গন্ধ হবে কিন্তু।

তখন যদি প্রশ্ন করো, কে জানছে, সেটা কী করে জানব?

রামকৃষ্ণদেব বলছেন, হুঁশ আছে? কী করছ হুঁশ আছে? হুঁশ মানে জাগা অবস্থা না। সে তো পাগলেও জেগে থাকে। হুঁশ মানে তুমি যে জেগে আছ সে খেয়াল আছে? বোধের গভীরে যে বোধ তোমার বোধকে দেখে যাচ্ছে সে বোধ হয়েছে? ওই গভীরতম বোধকেই আমি “মা” বলি। চৈতন্যময়ী। অখণ্ড চেতনার স্রোতে চৈতন্য, বুদ্ধই একটা বিন্দুমাত্র, তুমি কী তবে, ভেবে দেখেছ?

কী জানছ সেটা বড় কথা নয়, কে জানছে সেটাও খেয়াল রেখো। যে জানছে তাকে পরিশুদ্ধ করার কী পদ্ধতি বার করেছ? ধর্ম মানে চিত্তশুদ্ধি। তা সেই চিত্তশুদ্ধির জন্য কী ব্যবস্থা করেছ? কোন ডায়গনেস্টিক সেন্টারে তার পরীক্ষা হয়? শরীরের পরীক্ষার তো একটার পর একটা যন্ত্র বার করেই যাচ্ছ। মনের গতিও ঠাহর করতে শিখেছ। কিন্তু মন তো জড়। ধোপা ঘরের কাপড়। যে রঙে ছুপাবে সেই রঙ ধরবে। যে সঙ্গে মনকে রাখবে সেই সঙ্গের রঙ ধরবে, তবে? মনের মালিকের খেয়াল রাখো?

তাকে পরীক্ষা করার উপায় হল সাধুসঙ্গ। না না, সাধু মানে সেইন্ট, বা মঙ্ক না। কোনো ড্রেসকোড বা কোনো লাইফস্টাইল না। ব্যাধগীতা পড়োনি? সেখানে এক ব্রহ্মচারীকে শুদ্ধজ্ঞান দিচ্ছেন এক গৃহিনী আর এক ব্যাধ। ওই হল সাধুসঙ্গ। যে জেগে আছে বোধে, তার সঙ্গ। করো?

=======

সাপে ছোবলায়, বাঘে কামড়ায়, আরশোলায় চাটে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু মানুষ?

মানুষের ক্ষতি করার ক্ষমতা সহস্রনাগের মত। তার ছলচাতুরীর শেষ নেই। সংসারের মধ্যে ঢুকে দেখ সবাই সবাইকে ব্যবহার করে যাচ্ছে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে মা-বাবা অবধি। কেউ বাদ যাচ্ছে না। কেউ এক ইঞ্চি স্বার্থ ছাড়ছে না। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়াপ্রতিবেশি সবার মধ্যে চলছে ছলচাতুরীর গুপ্ত খেলা। কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। সবাই সবাইকে আড়চোখে দেখে। কবি বলেছিলেন।

মানুষের শরীর মনের সঙ্গে গিঁট দিয়ে বাঁধা। মন বিশ্বাসের তেলে চলে। বিশ্বাস নেই তো মন নেই। একজন মানুষ আরেকজন মানুষের সব চাইতে দীর্ঘমেয়াদি যে ক্ষতিটা করতে পারে, সে হল তার বিশ্বাসকে ভেঙে চুরমার করে দিতে পারে। তার বিশ্বাস করার ক্ষমতা যত দুর্বল হয়, তার বেঁচে থাকার পরিধি ক্রমে তত সঙ্কীর্ণ হয়। শেষে তার এক কারাগারবদ্ধ জীবন হয়ে দাঁড়ায়। কেন? বিশ্বাস করার ক্ষমতা হারানোর পঙ্গুত্বে।

প্রথমে বিশ্বাস অর্জন। তারপর তাকে নিজের সুবিধামত ব্যবহার করা। তারপর তাকে সুযোগ বুঝে ভেঙ্গে ফেলা। মানুষটাকে পঙ্গু করে দেওয়া।

ভবনাথের মন খারাপ। কেন? বন্ধুর সঙ্গে মনোমালিন্য হয়েছে। রামকৃষ্ণদেব বলছেন, তা দু একবার কথা বলার চেষ্টা করে দেখ, যদি কথা বলে তো ভালো। না হলে কি সেই নিয়ে বসে থাকবি? না না। যে মন ঈশ্বরকে দিবি সে মন এইভাবে কেউ বাজে খরচ করে?

রামকৃষ্ণদেবের দর্শনে এই এক অদ্ভুত প্রশ্ন? বারবার এ প্রশ্ন কথামৃতে ঘুরে ফিরে আসছে। মন কোথায় তোমার? হ্যাঁ গো, তোমাকেই বলছি, মন কোথায় রেখেছ?

মন পুষ্ট হয় কীসে? বুদ্ধি সমৃদ্ধ হয় কীসে? অনুরাগে। কী সেই অনুরাগ? সব জানতে পারবে। আগে রাজী হও। নিজেকে পরিশুদ্ধ করবে বলে যদি স্নানের ঘরে আসো, আমি তোমার ছোঁচাবার জলেরও ব্যবস্থা করে দেব। কিন্তু তোমাকেই নিজেকে নিজে শুদ্ধ করতে হবে। অনুরাগে।

কিন্তু কার উপর অনুরাগে?

নিজেকে জানতে জানতেই সে টের পাওয়া যাবে। আগে কলকাতায় এসো, এলেই কোথায় মনুমেন্ট, যাদুঘর খোঁজ পাবে। আগে নিজেকে শুদ্ধ করো। নিজের শুদ্ধমুখটা নিজের বোধের আয়নায় ধরো। তারপর একদিন খুঁজে দেখো সে আয়নাটা কী? কিন্তু আপাতত এসো।

ধীরে ধীরে অনুরাগে জন্মাবে দরদ। দরদ ধী জাত। সে দরদ ফোঁস করতেও জানে, ক্ষমা করতেও জানে। কিন্তু সে দুই কাজ করার ক্ষমতা জন্মায় ধারণা শক্তির উপর। সে ধারণা শক্তি জন্মায় সাধুসঙ্গের উপর। সাধুসঙ্গ করো মন, সাধুসঙ্গ করো। ডুব দাও যে ডুবে আছে তার সঙ্গে। যে ভাসছে তার হাত ধোরো না, ভাসিয়ে নিয়ে ছেড়ে দেব। যে ডুব দেয় আর ওঠে, তার হাতটা ধরো, সে পায়ের তলায় মাটি দেবে। এ বিষাক্ত সংসার থেকে বেরোবার ডুব সাঁতার শেখাবে। ডুব সাঁতার শিখে নিলে মূলের সন্ধান পাবে। মূল ছেড়ো না মন। মূল ছাড়লে সব ভুল।