Skip to main content

তুলসীদাসের রাম যে অযোধ্যায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেখানে ট্রেনে স্থূল শরীরে পৌঁছানো যায় না। কবীরের রাম দশরথের পুত্র রাম না। মহাত্মার রাম এ বিশ্বসংসারের প্রাণকেন্দ্রে থাকা সচ্চিদানন্দ। তুলসীদাস তাই দুই হাতজোড় করে সমগ্র জগতকে প্রণাম জানিয়ে বলেন - 'সিয়া রামময় সব জগ জানি'। রবীন্দ্রনাথের লেখায় বারবার রামের তথা রামায়ণের উপমা এসেছে। সে মাধুর্যের রসে সিক্ত। একটা ফুল দেখে তিনি বলছেন, এ যেন প্রভুর কাছ থেকে আসা অঙ্গুরীয়, যেমন সীতার কাছে অশোকবনে হনুমান নিয়ে গিয়েছিলেন, এই কথা বলতে যে প্রভু আপনাকে ভোলেননি, তিনি শীঘ্র আসছেন আপনাকে উদ্ধার করতে। এ তেমন। তাই রবীন্দ্রনাথের ভাষায় রামায়ণ ভাবগত সত্য, বস্তুগত না। যে রামকে ভারতবর্ষ চিরটাকাল আদর্শের প্রতিমূর্তি দেখে এসেছে। বন্ধু, পিতা, স্বামী, রাজা ইত্যাদি। তুলসীদাসজী রাম চরিত্রকে এঁকেছেন নিজের মানসমাধুর্যে। কোনো কূট তর্ক-বিতর্কে যেতে চাননি। যেমন সংগীত রসিক আওয়াজের মধ্যে সুর খুঁজে পায়, বিমূর্ত রাগের রূপ দেখে তেমন। অরসিকের কাছে কি ভৈরব আর কি পূর্বী। দুই শব্দ। তাই তার সম্বল তর্ক। রামায়ণ তর্কের জায়গা না। মাধুর্যের জায়গা। বিশ্বাসের জায়গা। আস্থার জায়গা। 
আজ রামনাম আতঙ্কের। অথচ যে মহাপুরুষের কন্ঠে এ নাম রাতদিন গীত হত সে মহাত্মার কণ্ঠে এ নাম ছিল অহিংসার মন্ত্র। তাঁর একমাত্র সম্বল। লক্ষ মানুষের মধ্যে প্রাণ সঞ্চারিত হত, আশা সঞ্চারিত হত এই নামের মাধ্যমে তাঁর আত্মায়। তার কারণ তিনি পরমাত্মাকে আত্মায় পেয়েছিলেন, বাইরে দলতন্ত্রের মধ্যে, বা সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে না। জলকে তত্ত্বত উপলব্ধি করেছিলেন বলে ঠাকুরের ভাষায় 'পানি', 'অ্যাকুয়া', 'ওয়াটার' সব সমার্থক করতে পেরেছিলেন। এক রাম তার হাজার নাম।
মুশকিলটা সেদিন হল, যেদিন রামকে পুরাণ পুরুষ থেকে ঐতিহাসিক পুরুষরূপে দেখা আমাদের বেশি জরুরী হয়ে উঠল। সেদিন বিরোধ বাধল, রক্তারক্তি হল। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, প্রয়োজনটা কম হলে আয়োজনটা বেশি হয়। বাল্মীকি থেকে রামকৃষ্ণদেবের চৌকাঠওয়ালা, মণিমানিক্যখচিত মন্দিরের প্রয়োজন হল না, কোথাও তার দরকার আছে বলেও গেলেন না, আজ হঠাৎ রামের আবাসস্থলের একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এর অর্থ আমাদের বাল্মীকি, তুলসীদাস, চৈতন্য, রামকৃষ্ণের রামের থেকে অন্য রামের প্রয়োজন বেশি। বিবেকানন্দ বলছেন, মন্দিরের অচল শিবের চাইতে সচল শিবের পূজা শুরু হোক। বলছেন দেশটাকে আদর্শে জাগাও, মানুষ তৈরি করে জাগাও। যার মূল কথা উদারতা, চৈতন্যের বিকাশ। অন্তরের রামের পথে চললে যা মেলে। তুলসীদাস বলছেন, 'পরহিত সম ধরম নাহি ভাই, পরপীড়ন সম নাহি অধমাই'।
অন্ধকার দূর করার উপায় 'অন্ধকার অন্ধকার' বলে চেঁচানো নয়, শুনেছি বহুবার কথাটা। অন্ধকার দূর হতে পারে তাই আবার যদি গভীর আন্তরিকতার সাথে এই মূলগ্রন্থের পাঠে ফিরে যাই মহাত্মাদের বাণী অনুসরণ করে। তুলসীদাসজী বলছেন, শাস্ত্র তো দুর্গম পাহাড়, সেখানে বহুরত্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এও সত্য। তবে সে রত্নের খোঁজে বিবেক-বৈরাগ্যকে ঢাল না করে যদি এগোতে যাও তো ভুলভ্রান্তিতে পথ হারাবে। কি খাঁটি কথা! বিবেক অর্থে সত্য-অসত্যের মধ্যে পার্থক্যজ্ঞান। আর বৈরাগ্য বলতে বলছেন, দর্শিত-কল্পিত-শ্রুত-শ্রুতব্য যাবতীয় বিষয়ের উপর নিরাসক্তি। অগত্যা বোঝা গেল তো "জয় শ্রীরাম” বলে ঝাঁপিয়ে পড়াকেই রামভক্তের লক্ষণ বলা হয় না, তুলসীদাসজী আরো বলেছেন, কপটতা হচ্ছে সবচাইতে বড় শত্রু এ পথের, মুখে রামনাম আর আচরণে রাবণের মত হলে বিপদ ভাই। রামজীকে তুষ্ট করার সহজতম পথ কি তবে? 
“সরল সুভাব, না মন কুটিলাই
যথালাভ সন্তোষ সদাই।” 
বলে তুলসীদাসজী বলছেন রামের মুখে, বলতো যে আমার ভক্তরূপে নিজেকে জগতে প্রচার করে অথচ অন্যের সাথে শত্রুতায় লিপ্ত হয় সে কি আমার ভক্ত?
বলছেন, শত্রুতা, পরমুখাপেক্ষিতা, ভীতি যদি ছাড়তে পারো তবেই তুমি আমার ভক্ত হওয়ার যোগ্য। তবেই হল, আচরণে ভক্ত হওয়ার কথা হল, আবরণের না, চীৎকারে না, দলতন্ত্রে না। বিশ্বাসে, স্থৈর্য্যে, ভালোবাসায়, শ্রদ্ধায়। তবেই রাবণকেও আর বাইরে দেখতে হবে না, ভিতরেই সোনার লঙ্কায় শুভবুদ্ধি সীতার অপহৃত রূপকে দেখতে পাব। কেঁদে উঠব, শুভ উদ্যমরূপী হনুমানজী আমার মতিতে বসবেন, আর ধীরে ধীরে পরমালোকরূপী রামচন্দ্র আমার অন্তঃস্থলকে অযোধ্যা গড়ে তুলবেন। মনে মনে সেদিনই সঠিক সুরে, সঠিক মাত্রায় উচ্চারণ হবে - জয় শ্রীরাম। গাইব -
ঈশ্বর-আল্লাহ্ তেরো নাম
সবকো সম্মতি দে ভগবান 
রঘুপতি রাঘব রাজারাম
পতিতপাবন সীতারাম
(আজ রামনবমী)