Skip to main content

বর্তমানে কর্পোরেট গুরুমহলে সদগুরুর নামটা বহুল পরিচিত। জাগ্‌গি বাসুদেব। তার দাবী তিনি আলোকপ্রাপ্ত পুরুষ। তিনি মানবকল্যাণে নিয়োজিত। সে কল্যাণে বহুল অর্থ-বিত্ত-নেতা ইত্যাদির যোগ। একজন বরিষ্ঠ সাংবাদিক তাকে রামরহিম, আশারাম ইত্যাদি ধর্মগুরুদের বিষয়ে মতামত জিজ্ঞাসা করেন। তিনি উত্তর করেন, তাদের আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না, মিডিয়ায় আমার বিশ্বাস নেই, আমি নিজের অনুভবের বাইরে কিছু বলি না, আর দেশের আইনের পথে তারা শাস্তি পাবেন।
        খাসা যুক্তি। কিন্তু কথা হচ্ছে 'ব্যক্তিগত অনুভব' -এর ক্ষেত্রটা কতটা? সে কি অলৌকিক মার্গের? যে কে কোথায় কি 'সু' অথবা 'কু' কীর্তি করছে তা সেই অলৌকিক যোগবলে না জানা অবধি নীরব থাকতে হবে? আর মিডিয়াকে বিশ্বাস না করলে তার নিজের এত মিডিয়া নির্ভর কাজকর্ম কেন? অবশ্য ওনার মতে মিডিয়া ওনার পিছে ধায়, উনি নন। সে কথা থাক, তবে কি ইঙ্গিতটা এরকম যে আশারাম, রামরহিমে মিডিয়া রঙ চড়িয়েছে?
        আমাদের সমস্যাটা এখানে। সদগুরুকে নিয়ে চর্চা করার জন্য এ লিখতে বসিনি। আজ অর্থাৎ রোববার ১০ই সেপ্টেম্বরের আনন্দবাজারে আরেকটা খবর আছে যে বিবেকানন্দকে এতদিন বস্তুবাদের আবরণে ঢেকে তার ভাবমূর্তির সর্বনাশ করা হয়েছে, অগত্যা তার 'হিন্দুনেতা' ইমেজটাকে জনসমক্ষে তুলে ধরতে হবে। তার প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গেছে। এরকম যে কিছু একটা ঘটতে চলেছে বেশ কিছুদিন আগে স্পষ্ট লিখেছিলাম বিবেকানন্দ সম্পর্কিত একটা পোস্টে। আজ পূর্ণাবয়বে সে মূর্তিটা ধরা দিল। আজ আর ইঙ্গিত না, ঘোষণা।
        বিবেকানন্দ কি হিন্দুনেতা ছিলেন? ছিলেন। স্পষ্ট উত্তর। তবে সেটি তার একমাত্র পরিচয় যে নয় তা বলা বাহুল্য। তার মধ্যে স্ববিরোধ কি নেই? প্রচুর আছে। তাতে তার প্রতিভার কিছুমাত্র মান ক্ষুন্ন হয় না। কারণ সেদিনের বাতাবরণটার দিকে চোখ রাখলে, সেদিন ভারতের পক্ষে জাগবার একটা মূল অস্ত্রই ছিল হিন্দুধর্মের সংস্কারের মাধ্যমে জাতটাকে আবার জাগিয়ে তোলা। রামমোহনের বেদান্ত নির্ভর জাগরণ, এক ঈশ্বরের উপাসনার প্রচলন থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথের অজস্র গান, প্রবন্ধ, কবিতা অবধি সে ঢেউ বর্তমান। গান্ধীর ক্ষেত্রেও তাই। অরবিন্দও সেই পথেরই পথিক। তবে গান্ধী-অরবিন্দ-রবীন্দ্রনাথের হিন্দুধর্মের থেকে বিবেকানন্দের হিন্দুধর্ম কিছুটা আলাদা। রবীন্দ্রনাথের হিন্দুধর্ম ধীরে ধীরে 'মানুষের ধর্ম' হিসাবে পরিণতি লাভ করে। বোধহয় ভারতের প্রথম প্রতিভা যিনি 'আন্তর্জাতিক মানসে' আমাদের চিত্তকে ডেকেছিলেন। আধুনিক চিন্তা বলতে তা পাশ্চাত্যের অনুকরণ নয় কিম্বা আমাদের ধর্মের যুগসঞ্চিত কুসংস্কারের আধুনিক ব্যাখ্যাও নয়। তা আমাদের ভিতরের দেশ-কাল অতীত যে মনুষ্যত্ব তার নিরিখে জগতে কর্মযজ্ঞে নামার আহ্বান। অমর্ত্য, সত্যজিৎ, নন্দলাল, জগদীশ, সত্যেন বোস ইত্যাদি নানা আধুনিক ভারতের রূপকারের জীবন মননের সাথে যুক্ত সে পরীক্ষাগার - শান্তিনিকেতন। কোনো মঠ-মিশন থেকে তারা জন্মাননি, কিম্বা প্রগতিশীল চিন্তায় খুব প্রভাব সেই ধর্মীয় সংগঠনগুলো ফেলেছিল বলেও আমার অন্তত জানা নেই।
        তবে বিবেকানন্দ যে যুক্তিশীল হওয়ার জন্য, সেবামূলক কাজে ব্রতী হওয়ার মাধ্যমে ধর্ম অনুসরণের আহ্বান জানিয়েছিলেন শুধু না, হিন্দুধর্মের একটা সার্বভৌম দর্শন আছে - এই সত্যটা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরে আমাদের দেশের সেই সময়ের আত্মবিশ্বাসে যে প্রবল একটা অনুপ্রেরণার জোয়ার এনেছিলেন সে কথা অনস্বীকার্য। সে আত্মবিশ্বাস ক্রমশঃ ধর্মের ক্ষেত্র ছেড়ে দেশপ্রেম তথা স্বাধীনতা আন্দোলনে সাংঘাতিক ঢেউ তুলেছিল। সি রাজাগোপালাচারীর অনেক লেখায় এর বিবরণ আছে। তাছাড়া গান্ধী, নেতাজী, রবীন্দ্রনাথ সকলেই এ কথা একবাক্যে স্বীকার করেছেন দেশের ভিতর এই জেগে ওঠার কেন্দ্রবিন্দুটাকে জাগিয়েছিলেন বিবেকানন্দ তার ধর্মের ধ্বজা উড়িয়ে। আসলে সেদিন আমাদের একজোট হওয়ার জন্য এছাড়া কোনো পথ ছিল না। তবে সে কথা সম্পূর্ণ সত্যিও নয়। আমাদের দেশে নানা জীবন দর্শন, আদর্শ, নানা পরীক্ষার মাধ্যমে যে একটা বিশাল বৈচিত্র্যময় সমাবেশ তৈরি করেছিল, যাকে আমরা 'হিন্দুধর্ম' নামে একত্রে চিহ্নিত করতে চেয়ে আসছি, তা কেবল বর্বরতা, আর সতীদাহ দিয়ে ব্যাখ্যা করতে গেলে অবিচার হবে। এই মাটিতে 'ভূমা' থেকে শুরু করে 'সর্বে সুখী ভবন্তু' ইত্যাদি নানা প্রার্থনা উচ্চারিত হয়েছিল, যা একদেশী নয়। উপনিষদ তথা নানান ধর্মীয় সাহিত্যে মানবতার এমন উচ্চ-উদার আদর্শের কথা শোনানো হয়েছিল যা বিশ্ব সাহিত্যে বিরল। সে কথাই ধ্বনিত হয়েছিল বিবেকানন্দের কণ্ঠে শিকাগো ধর্ম মহাসভায়।
        তবে মাটির যেমন উর্বরতা হ্রাস পায়। তাকে পুনরুজ্জীবিত করতে নানা প্রকল্প লাগে, বিশেষ চরিত্রের গাছ বুনতে হয়, তেমন ধর্মের ক্ষেত্রেও। ধর্মের উদারতা, জীবনীশক্তিও হ্রাস পায় কালের গতিতে। কোনো মহাপুরুষের জীবনে তা আবার পুনর্জন্ম লাভ করে, আবার মানুষকে বেঁচে থাকার সদর্থ শেখায়। হিংসা, ক্ষুদ্রতা, লোভ থেকে মুখ ফিরিয়ে বৈচিত্র‍্যের মধ্যে সহাবস্থানের পথ দেয়। নানক, কবীর, দাদু, চৈতন্য, রামকৃষ্ণ, শিরডির সাঁই - এনারা সেই গাছগুলো যারা ধর্মকে আবার নিজের জীবনে ধারণ করে দেখিয়েছেন, ধর্মগ্রন্থের পাতার সাথে মিলিয়ে নয়, বিবেকের সাথে সদ বিবেচনার আলোকে। মানুষ প্রাণ পেয়েছে, জেগে উঠেছে। পোলিটিকালি কারেক্ট হয়ে উদারতার ঘোষণা আর প্রাণের কেন্দ্রে বিশ্বনিখিলের সাথে যুক্ত হওয়ার আনন্দে সবাইকে নিজের জানার মধ্যে যে বিপুল পার্থক্য বলতে দ্বিধা নেই সে ধর্মের মাধ্যমে চিরটাকাল মানুষ পেয়েছে। যেখানেই পায়নি সে ধর্মের সাথে নিজেকে ব্যর্থ করেছে।
         আজ সে ধর্মের স্থান নিয়েছে বিজ্ঞান। যাই অন্ধকার দূর করে তাই ধর্ম। গুরুর অর্থ যিনি অন্ধকার দূর করেন। তবে কোন বিজ্ঞানীকে আমাদের গুরুর সংজ্ঞার বাইরে রাখতে পারি? কোন বিশ্ব সাহিত্যের অমূল্য লেখক যারা মানব হৃদয়ের গভীর রহস্যের কিনারা দেখিয়েছেন তাদের এই সংজ্ঞার বাইরে রাখতে পারি? কাউকে পারি না। আর ভয়টাও সেখানেই।
        ভারতের একটা স্বভাব আছে - আত্মমোহে বাস। যে কারণে সে বারবার বিদেশী শত্রুর হাতে পরাজিত নিগৃহীত হয়েছে। আজ সে আবরণে ঢাকার পুনঃপ্রচেষ্টা দেখতে পাচ্ছি। বিচ্ছিন্নতার মধ্যে নিজের সত্তা খোঁজার চেষ্টা ভারতে আগেও হয়েছে। জাতের কঠিন নিয়ম, আচারের অমানবিক বাড়াবাড়ি সে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার কৃপণ কৌশল। এতে চিত্তের ক্ষুদ্রতা, বিকারই বাড়ে। মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আবার জড়ত্ব আসে। নিজেকে কিম্ভূত জগতের অধিবাসী করে সারা জগতকে ম্লেচ্ছ তকমায় ভূষিত করে আত্মপ্রসাদ লাভ করা যায়। কিন্তু অবশেষে আমরা একটা বিচ্ছিন্ন প্রাণীগোষ্ঠী হয়ে বিশ্বে দরবারে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা হারাই। সেটাই ভয়ের। যে অস্ত্র এককালে কাজে লেগেছিল তাকে মিউজিয়ামে শোভা পায়। কিন্তু আজ যদি তাকে বাইরে এনে আবার একটা কৃত্রিম যুদ্ধ ঘোষণা করে, কৃত্রিম দেশপ্রেমের বন্যা জাগিয়ে একটা মোহ তৈরি করে ঘোলা জলে মাছ ধরার কৌশল ফাঁদি তবে আখেরে তা দেশের দশের পক্ষে অমঙ্গলই ডেকে আনে। শ্রদ্ধার বস্তু আর কাজের বস্তু এক সবসময় হয় না। প্রথম যে মাইক্রোস্কোপে কোষের আকার অনুধাবন করা হয়েছিল, তার প্রতি অসীম শ্রদ্ধা রেখেই আমরা ইলেকট্রণ মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করি। কিন্তু আজ যদি কেউ সব ইলেকট্রণ মাইক্রোস্কোপ সরিয়ে সেই প্রাচীন মাইক্রোস্কোপ নিয়ে আসার প্রয়াস পাই? তবে যে সমূহ ক্ষতি? আর যেখানে সেই বীজটা আমাদের রক্ত থেকে নির্বাসিত হয়নি এখনও। এখনও আমরা ধর্ষক গুরুর হাত ধরে পরকালে যাওয়ার পথ খুঁজি। বাস্তবকে অস্বীকার করে নিজের তৈরি এই আত্মসম্মোহনসৃষ্টিকারী সংস্কৃতিতে যে ভীষণ ভয় পাই।
        একটা ঘটনা বলে শেষ করি। বাবাকে যেদিন হাস্পাতালে ভর্তি করে মধ্যরাতে ফিরছি কলকাতা থেকে, সেদিন একটা বেলুড় মঠ সংক্রান্ত পোস্ট করে অনেকের বিরাগভাজন হয়েছিলাম। মেসেঞ্জারে, কমেন্টস বক্সে অনেক আক্রমনাত্মক, আমার ভ্রমনিবারক মেসেজ পাই। যার মোদ্দা কথা ওনারা অত ভালো ভালো কাজ করেন, আপনি তার উল্লেখ না করে এইসব লিখছেন কেন? মনটা সেদিন দুর্বল আমার। মনের কোনায় একটা অল্প ভয় এলো ক্ষণিকের জন্য, বাবার এমন সংকটজনক অবস্থা, এমত অবস্থায় আমার কি উচিৎ হচ্ছে এমন ধর্মীয় স্থানের প্রতি কটাক্ষ করা? দুর্বল মনের বিকার যা করে তাই হল। মাকে হারানোর জন্য একজন ধর্মগুরুর শিষ্য আমায় বলেছিলেন, আমি অমুক মতে দীক্ষা না নেওয়ার জন্যই এই পরিণতি ইত্যাদি। আমার আরো ভয় করল।
        রাত আড়াইটে নাগাদ আমার বাড়ির সামনের মাঠে গাড়ি আমায় নামিয়ে চলে গেল। আমি মাঠে বসলুম। মাথার উপর চাঁদ উঠেছে। চারদিক ঘুমন্ত নিস্তব্ধ। আমার হঠাৎ মনে হল জীবনে কাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে এসেছি - ভয়কে না সত্যকে? মন বলল, সত্যকে। তবে যা নিজে দেখেছি, অনুভব করেছি, সাক্ষী থেকেছি, অভিজ্ঞতাপ্রাপ্ত হয়েছি, তাকে অস্বীকার করে কোনো 'বিশাল' কাজের মোহে কেন সত্যভ্রষ্ট হব? হলাম না। মনে হল যা হয় হোক, যদি সত্যি কোনো মহান শক্তি আমার ক্ষতি করেন, করুন; জানব তিনি আর যে হন সত্য নন। যা ক্ষতি হয় হোক, সত্যভ্রষ্ট হলে সব হারাব। সেই আমায় শক্তি দিল। সারাটা বিশ্বের সাথে নিজের যোগসূত্র পেলাম। সেই-ই মঙ্গল যা সত্যে প্রতিষ্ঠিত। তাই ধর্ম। তার কোনো গ্রন্থ হয় না। তা মানুষ তার চেতনার জন্মলগ্ন থেকেই পায়। সেই ভরসা। সেই আশা। ভয়ে না, মানুষ এগোয় সত্যের আলোকে, বোধের আলোকে।