Skip to main content


রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘যদি বলি মানুষ মুক্তি পেতে চায়, তবে মিথ্যা কথা বলা হয়। মানুষ মুক্তির চেয়ে ঢের বেশি চায়, মানুষ অধীন হতেই চায়... সে বলছে, হে প্রেম, তুমি যে আমার অধীন, আমি কবে তোমার অধীন হব!’

এ কি সত্যিকারের আকুতি? নাকি নিছক বানানো কথা? মানুষের গভীরের অংশটা চাপা থাকে, উহ্য থাকে। তবে নিষ্ক্রিয় থাকে না। সেখান থেকে তার কলকাঠি নাড়ানোয় আমাদের মনে নানা আন্দোলন। মানুষের মন যদি একস্তরবিশিষ্ট একটা সত্তা হত তবে এতো জটিলতার প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু তা তো নয়। তাতে স্তরের পর স্তর। এক স্তরের সাথে আরেক স্তরের সংঘর্ষ আচমকাই। বাইরের মনে ধাক্কা। আমরা অবুঝের মত বাইরে তার কারণ হাতড়ে বেড়াই। খুঁজে বেড়াই এর ওর কাছে তার সমাধান। একে ওকে সেধে মরি – 'ওগো আমার একি হল...', 'রাতে ঘুম নেই...', 'সারাদিন মনে অশান্তির ঘূর্ণি...', 'জ্বলেপুড়ে গেলাম...' ইত্যাদি। সে কি করে বুঝবে তার মনের তলদেশে তখন চলছে স্তরে স্তরে সংঘর্ষ। চলছে নবনির্মাণ। কে করছে? কেউ জানি না। আস্তিক বলবেন আত্মা বা ঈশ্বর। নাস্তিক বলবেন, ঘটনাপ্রবাহের এমনই ধারা – অনির্দেশ্য ও অনির্দিষ্ট।
যেমন একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। মানুষ একটা আশ্চর্যরকম আশা নিয়ে বাঁচে – কোনো একদিন তার মনের মানুষটাকে সে খুঁজে পাবে। ঈশ্বর যাকে তারই জন্য যেন এই সংসারে পাঠিয়েছেন। সে যাকে খুঁজছে তাকে সে পাবেই পাবে। পায় না। তাকে গল্পে খোঁজে, সিনেমায় খোঁজে, বিদেশে খোঁজে, স্বপ্নে খোঁজে। পায় না। যাকে পায় তার মধ্যে তার রূপটাকে আপ্রাণ মিলিয়ে নিতে চেষ্টা করে। কিছুটা হয়, বেশিরভাগটাই বাদ পড়ে যায়।
ঠাকুমার মুখে শুনেছিলাম, পুরাণে নাকি আছে, দ্রৌপদী তার গতজন্মে এমন স্বামী প্রার্থনা করেছিলেন যার মধ্যে ধৈর্য্য, বীর্য, সুপ্রেমিকতা, ধর্ম, কোমলতা ইত্যাদি নাকি সব গুণ থাকবে। তা বাস্তবে তো সেটা সম্ভব না। তাই নাকি পাঁচজন স্বামী পেয়েছিলেন, যাদের মিলিত গুণাবলী তার কাঙ্খিত গুণাবলীর সমষ্টি। গল্পটা মনে ধরেছিল। তাই হয়। মনে মনে তাই মানুষের বাঁয়ে-ডানে দৃষ্টি চলেই যায়। চোখে ঠুলি পরে চরানোর যে চেষ্টাটা সমাজ করে আসছে, সে ধর্মেরই হোক, বা শাসনেরই হোক, মানে পিনাল কোডের শাসন আর কি, তবু চোখ তো যেতে চাইবেই। আবার এই সমাজটাও তো আমারই সৃষ্টি, আমার মধ্যে আমিই তো সমাজ, যতই উপেক্ষা করি, সেও তো জানি ডানা ব্যথা হলে নীড়েই ফিরতে হবে। মাসীমা-পিসীমার পাশে এসে বসতে হবে, শক্ত ডানাওয়ালাগুলোকে তেড়ে গালাগাল করতে হবে, শিষ্টাচার শেখাতে হবে। কারণ নিজেকে যতই স্বেচ্ছাচারিতার ছাড়পত্র দিই না কেন, নিজেদের সন্তানদের তো একটা সমাজই দিতে হবে না? সুস্থ, শিষ্ট, ভদ্রমানুষের সমাজ! কি অসম্ভব স্ববিরোধিতা। হতেই হবে। তবেই তো হলাম গিয়ে মানুষ। টলতে টলতে সামলানো অভ্যাস করাই তো জীবন।
সে যা হোক। কথা হচ্ছে সেই মনের মানুষটার পূর্ণরূপটা কোথাও যখন কোনোভাবেই আর মিলছে না, তখন ধর্মে, কল্পনায়, অন্তরে তাকে নানান রূপে আঁকার প্রয়াস পাওয়া গেল। এখানে একটা মজার ছাড় আছে। আমরা তাই বিশ্বাস করি বা বুঝি, যা আমরা আদতে মনের গভীরে বুঝতে বা বিশ্বাস করতে চাই। ফলে নিজের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে এই মনের মানুষ খোঁজার খেলায় ইতি টানি। যদিও গভীরে সে চলতেই থাকে। তার আভাস পাই হঠাৎ উপচে পড়া খুশীর মুহুর্তে চোখের জলের আচমকা আবির্ভাবে। বুকের মধ্যে প্রচণ্ড হাসির দমকের মধ্যেই অপরিচিত কোনো চিরাকাঙ্খিত মুখের বেদনার্ত উদ্ভাসে।
তবু এইখানটাতে এসে সে নিজেকে আর তার আশপাশের মানুষগুলোকে সম্পূর্ণরূপে পায়। কারণ এবার তার খোঁজের তৃষ্ণাটা নেই। আছে মিলবার তৃষ্ণা। সবার অপূর্ণতার সাথে নিজের অপূর্ণতার মিলনে পূর্ণরূপের আস্বাদন। তাই তার এত উৎসব। সেই সবকে যদি বলো ঈশ্বর, মেনে নিই। আর যদি কোনো এক খামখেয়ালি, আমার থেকে বিচ্ছিন্ন সত্তাকে বলো ঈশ্বর – তো বলব অমন ঈশ্বরের ক্যাঁতায় আগুন। সে ব্যাটা, যাকে ভালোবাসি যদি তার চোখের মধ্যে ধরা দিতে না পারে, তবে অমন মুরোদহীন, ইনসিকিউরিটি কমপ্লেক্সে ভোগা ঈশ্বরকে চাই না। কিন্তু তাকে তো ভালোবেসেই পেয়েছি, তাই ঐশ্বর্য্যকে আমার এত ভয়, তার প্রথম হাত পড়ে আমার ভালোবাসায়। আমার ঈশ্বর দীনহীন হোক, চলবে; আমিও তাই থাকি, মরেও বাঁচব। বেঁচে মরে থাকার সে ঢেরগুণ ভালো।
তাই শুরুর কথাটা আবার শেষে বলি। অধীন হতেই চাই। প্রেমের। শুদ্ধ প্রেমের।