Skip to main content

     যেটা মিথ্যা, তার সাজ বেশি আস্ফালন বেশি এ তো চিরকেলে কথা। তা যতক্ষণ বাইরে দাপায় ক্ষতি সেই প্রকার দেখি না। বিপদ হয় যখন সে মনের মধ্যে চেতনার অগোচরে বাসা বাঁধে। তখন তার এক-একটা প্রবল পাকে মন নিস্তেজ, মোহগ্রস্ত হতে শুরু করে। আরো একটু খোলসা করে বলা যাক। যেমন ধরা যাক কেউ আমাকে একটা খুব সস্তা দামের পেন বেশি দামে বিক্রি করে গেল। আমি ঠকলাম, কিন্তু বিভ্রান্ত হলাম না। লিখতে গিয়েই টের পাব আমি ঠকেছি। কিন্তু যারা ধর্মের নামে, রাজনীতির নামে, শিক্ষার নামে আরো কতভাবে মনের মধ্যে মিথ্যার বীজ বপন করে চলেছে! কি বীভৎস করুণ তার পরিণাম! হাতেনাতে ভুল উপলব্ধি করব সে সম্ভাবনাও নেই, আবার দৈবাৎ মনের গভীরে সন্দেহ জাগলেও তাকে যে বাইরে প্রকাশ করব সে সাহস ও নেই, কারণ বহু মানুষ তাই সত্য বলে মেনে চলেছে যে! তারা গর্জে উঠে বলবে, "তুমি কি সত্য জেনেছ, মানে যাকে পরম সত্য বলে?" বলতেই হবে, “না জানি নি। কিন্ত তুমি যা সত্য বলে মেনে চলেছ তা কি সত্য?" সে বলবে,"আলবাত সত্য।" আমি জানতে চাইব, “কি করে?” সে বলবে, "এতে যে পরম শান্তি!" হায় রে! সে যে শান্তির বেশে বহুকালের অভ্যাসের জড়ত্ব, সে বোঝাব কি করে! তার সৃষ্টি নেই, পুনরাবৃত্ত আছে; তার প্রশ্ন নেই, অথচ উত্তর আছে; তার আনন্দ নেই, উল্লাস আছে।

     তাই শুরুতে বলছিলাম, যে মিথ্যা মনের মধ্যে বাসা বাঁধে তার হাত থেকে মানুষকে রেহাই দেওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে ওঠে। আর যে সমাজ যত পুরোনো তার এ সমস্যা তত গভীর। আজও এই আধুনিকোত্তরযুগে দাঁড়িয়েও মনের যে সব অন্ধ গতিবিধি নজরে আসে তাতে বিস্ময়ের সীমা-পরিসীমা থাকে না। বুঝি, বিজ্ঞান যত উন্নতিই করুক তা বাইরের জীবনকে যত মসৃণ করুক, মনোরাজ্যে সে বহিরাহতই থেকে গেছে।


     আলোকিত যুক্তি, উন্মুক্ত আলোচনা, ভিন্নমতের সহাবস্থান এক ঔদার্য মহানুভবতায় - এ আমাদের অধরাই থেকে গেল সভ্যতার এতটা পথ পেরিয়েও।

 

     তবে এও জানি কোনো মিথ্যাই বেশীদিন স্থায়ী হয় না স্বাভাবিক নিয়মে। তাই যত না ভয় মিথ্যাকে তার চেয়ে বেশি ভয় মিথ্যার পৃষ্ঠপোষক দের। তাদের সুচতুর ভঙ্গী এরকম কত মিথ্যাকে আজও লালিতপালিত করে চলেছে তার পরিণাম চারিদিকে চোখ রাখলেই দেখা যায়। আজও তাই ভরসা সুসাহিত্যের, যা ভাবাবে, মিথ্যা সান্ত্বনায় আমার আত্মশক্তিকে খর্ব করবে না। এমন শিক্ষকের যিনি তাঁর সংশয়কেও সম্মান করবেন ও প্রকাশ করবেন আগত প্রজন্মের কাছে। তাদের সংশয়কেও আশ্রয় দেবেন তাঁর মুক্তচিন্তার পরিসরে। তবে মিলবে সোজা পথ। চড়াই-উতরাই থাকবে তাতে ক্ষতি নেই, কিন্তু ঘুর্ণাবর্ত থাকবে না।