এক, আমি নিজে; দুই, আমার সমাজ; আর রইল বিশ্বচরাচর। এই তিনকে ঘিরে একটা জীবন। এই তিনটেকে গেঁথে একটা সূত্র আছে - দর্শন। একজন মানুষ জেনে হোক, না জেনে হোক, কোনো না কোনো একটা দর্শনে বিশ্বাস করে। তার সেই বিশ্বাসের সাথে তার আচরণ যত খাঁটি সে তত স্বচ্ছ। তার সে দর্শন যত উচ্চ, সে তত মুক্ত। জ্ঞান না সুখ? জ্ঞানের মধ্যে সুখের খোঁজ যার, তাকে আমরা দার্শনিক বলি। আর সুখ খুঁজতে গিয়ে যে নানা ভাবে অভিজ্ঞ, তাকে সংসারে খুব একটা কেজো লোক বলি। অবশ্যই সক্রেটিসের কাছে যে সুখের অন্বেষণ আর কোন খাতে কত টাকা কিভাবে জমা রাখলে ভবিষ্যতে কি কি সুবিধা - এর খোঁজ দেওয়া মানুষ এক হতে পারে না। এদের মধ্যে একজন চাইলেই অন্য হতে পারে না। তাই এখানে দ্বন্দ্বযুদ্ধের অবকাশ নেই। নিজের স্থান, রুচি অনুযায়ী মানুষ নিজের গন্তব্য স্থির করে এসেছে যুগযুগ ধরে।
জ্ঞানান্বেষণ অপর অর্থে সত্যের খোঁজ, তত্ত্বগতভাবে। এ এক অনন্ত খোঁজ। কেউ এর প্রান্তে পৌঁছায় না। এ পথের পথিক হতে পারাতেই নিজেকে সার্থক মনে করে সে। ঘর থেকে সমুদ্রে যাওয়ার পথ পাওয়া যায়, সমুদ্রকে ঘরে আনার পথ কি মেলে? সে ভ্রম। মানুষ যেখানে নিঃসংশয়ত্ব বোধ করে, সেখানেই যখন সে প্রশ্ন করার স্পর্ধা দেখায়, সেই হয় তার সত্য অর্থে সত্যের খোঁজ। কারণ সব ক'টা থামার একটা সুখ আছে, সেই সুখের উৎখাতেই গতির সূচনা। এই কারণেই জ্ঞানের পথিকরা সুখের বিরোধিতা করে এসেছেন, কিছু কিছু অর্থে সেই বিরোধিতা মাত্রাতিরিক্ত হয়ে বিকারের জায়গায় পৌঁছিয়ে যায়নি যে তাও বলা যায় না। অনেকে এমন ধারণাও পোষণ করেছেন যে নিজেকে যত উৎপীড়ন করা যায় তত বেশি জ্ঞানালোকের কাছে থাকা যায়, এও ভ্রম, মোহ। যে স্থান থেকে ফেরার তাগিদ বুদ্ধ অনুভব করে মধ্যপথের কথা বলেন।
তবে সুখের মোহ একটা আছে। সে সত্যের ভান করে বিভ্রান্তির মধ্যে বসিয়ে রাখে। যে সুখে জগন্নাথকে হিন্দুনাথ করে নিশ্চিন্তে ভক্তের দল দিন যাপন করছিলেন, হঠাৎ ঘুম ভাঙিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বলে বসল, দাদা একটু উঠবেন, বলি কাজটা কি ঠিক হচ্ছে?
তবে কোথায় থামব? থামার মধ্যে যে একটা সুখ আছে। কেন সে সুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করব? এমন একটা সিদ্ধান্তে আমায় স্থির করে দাও যাতে ঈশ্বর থেকে সংসার সব কিছুর সুখ আমার করায়ত্ত হয়ে থাকে, আমি তোমায় গুরু মেনে ঈশ্বরের ঊর্দ্ধে স্থান দেব, দেখো! এরকম শিষ্যের অভাব নেই বলেই আমাদের দেশে সেরকম গুরুরও অভাব হয়নি কোনো কালে, যার নির্দেশের একশো আটটা পুঁথির মালায় বিশ্বের যাবতীয় সুখের তথা জ্ঞানের সূত্রের ধাঁধা মিলে গেছে।
আমাদের দর্শনে থামার দিকে যত ঝোঁক ততটা পাশ্চাত্য দর্শনে নেই। তাদের ঝোঁক চলার দিকে। আমরা যখন দরজায় শেষ ছিটকিনিটা চিরকালের জন্য মারার ফিকির খুঁজি, পাশ্চাত্য তখন আরো কয়েকটা খোলা দরজা রাখে আগামী প্রজন্মের জন্য। তাই আমাদেরটা হয়ে রইল অতীন্দ্রিয়ের আবর্তে ভুলভুলাইয়া, ওদেরটা হয়ে রইল পথ। আমরা বসার ফিকির খুঁজি - যাঁকে জানলে সব জানা হয়ে যায় তিনি ব্রহ্ম। ব্রহ্ম কি? যাঁকে মুখে বলা যায় না, ব্যাখ্যাতীত। একটা অন্ধকার ঘরে একজন অন্ধ মানুষ। এ এক প্রবল সম্ভাবনাময় অবস্থান। সে যা খুশী মনে করতে পারে। জগতটা মিথ্যা, জগতটা লীলা, জগতটা অর্ধেক মিথ্যা অর্ধেক লীলা, জগতটা চেতনা, জগতটা জড় ইত্যাদি ইত্যাদি। তার তো নিশ্চয়তা মানে তার নিঃসংশয়তার নিশ্চয়তা। যে নিঃসংশয়তা তার আলোহীনতার শান্তি আশ্রম।
তাই আজ এত বছর পর, সারা বিশ্বের গতিময়তা থেকে মুখ ফিরিয়ে আমাদের প্রবল মল্লযুদ্ধ এখনও ধর্মের মল্লভূমে। একজন মানুষ তার যৌন সম্পর্ক সমলিঙ্গে না বিষমলিঙ্গে হবে সেই নিয়ে আলোচনা, বাদ-বিতণ্ডা বছরের পর বছর ধরে। বিজ্ঞান বলো, পরিবেশ বলো, শিক্ষা বলো, স্বাস্থ্য বলো - এসবের আলোচনায় সময় নেই আমাদের। ওসবে পাশ্চাত্যের অনুকরণ কাম্য, যদিও তাদের গালমন্দ করতে করতেই, কারণ প্রাচীন ভারতে সব নাকি ছিল, ওরা চুরি করে এগিয়ে গেল, আমরা ভাগ্যের পরিহাসে পিছিয়ে রইলাম।
সামগ্রিক জীবনে রুদ্ধগতি থাকলে ব্যক্তিগত জীবন বিষাদ আর ক্ষণিক আমোদের ধারাবাহিকতা ছাড়া কিছুই হয় না। ভারতীয় অন্দরমহলের জীবন সেই ছন্দে এখনও। আজও তার পদে পদে দীর্ঘশ্বাস - দাও ফিরে সে বেদান্ত, লও এ বিজ্ঞান। রথ বহুকাল হল আটকে। লক্ষকোটি জনসাধারণ নিজের চলার পথই খুঁজে পায় না, তো সে পরমাত্মার চলার পথ খুঁজবে, তাই তাঁকেও নিয়ে গিয়ে মাসির বাড়ির দোরগোড়াতেই থেমেছে। ওর বেশি এগোনোর দুঃসাহস দেখায়নি। যিনি বিশ্বচরাচরের প্রভু তাঁরও নাকি নিজের পরিবার আছে, মানে মাসি পিসি আছে। এ সেই থামার কথা। এই থামাতে একটা রোম্যান্টিক ভাব আছে, দেখো আমরা বৃহৎকে কেমন ক্ষুদ্র করে পেয়েছি। সেটা অবশ্যই গর্বের কথা হত, যদি সেই বৃহৎ তার ক্ষুদ্রত্বে স্বধর্ম না হারাতো। একটা মিছরির টুকরো যত ক্ষুদ্রই করা হোক না কেন, সে তার মিষ্টত্ব ছাড়ে না, যদি ছাড়ে তবে সে বালির কণা ছিল। তাই মহৎকে নিজের ক্ষুদ্রত্বের সীমানায় আনার সাধনা বড় সুখের নয়। কিন্তু আমরা যে সুখ চাই, তার কি হবে? তাই ফাঁকি এসে জমল। সত্যের ভানে নানা তত্ত্ব এসে বসল। তা নিয়ে এমন কোন্দল বাধল যে আজও সমাধান হল না। রথের চাকা সুখের গর্তে আটকে। জ্ঞানের পথে, সুখকে জলাঞ্জলি দিয়ে এগোনোর কথা, সেখানে কোনো প্রান্তিক স্টেশান নেই, এটা মনে না রাখলে মননের জগতে আমাদের থোড়-বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি-থোড় হতেই থাকবে।
সৌরভ ভট্টাচার্য
14 July 2018