পণ্ডিত বলল, যে একই সঙ্গে দুটো খরগোশ ধরতে যায়। সে একটাও পায় না। বাউল বলল, এক মন যার সেই যেতে পারে।
পাণ্ডিত্যে দ্বন্দ্ব আছে। বিরোধ আছে। বাউলে মিলন আছে। অনুভব আছে। রবীন্দ্রনাথ বাউলের সামনে বসেছিলেন। ‘মানুষের ধর্ম’ নিয়ে বিদেশে বলতে গিয়ে বাউলের ধর্মের কথা বলেছেন। গোটা জগৎ যখন ঈশ্বরকে তত্ত্ব করতে ব্যস্ত, আস্তিক নাস্তিকতার জ্বরে আক্রান্ত, বাউল তখন মানুষ খোঁজে। বাউল বলে, এ মানুষে সে মানুষ আছে।
বাউলের ধর্ম বাংলার মূল। মহাপ্রভুর অনুভবের নির্যাস। মানুষ তো পাগলই। ইদানীং পাশ্চাত্যের পণ্ডিতদের মধ্যে মানুষের ‘ইর্যাশেনাল’ দিকটা নিয়ে খুব চর্চা হচ্ছে। ইর্যাশানেল মানে এখানে অপ্রকৃতস্থ না। বেহিসাবি। অর্থনীতির লোকেরাও বলছে, মানুষের মধ্যে একজন বেহিসাবি মানুষ আছে। বাউল সেই বেহিসাবি।
বেহিসাবি মানে কী? মানে হিসাবের নাগালের বাইরে হিসাবকে আর না টানা। এইখানেই মরমী বসে। এখানেই মুক্তির আনন্দ। বুক ভরা শ্বাস। হিসাব মিলাতে গেলে হিসাব মেলে না। হিসাবের আঙিনায় হিসাবকে রেখে এলে হিসাব আপনিই মিলে যায়। দম্ভ বোঝে না। দরদ বোঝে। মানুষ যখন দম্ভপাগল, তখন হিসাবকে টেনে টেনে ‘মিথ অব সিসিফাস’ এর গল্প ফাঁদে। বাক্য, যুক্তির চাকচিক্যতে মানুষ ধন্দে পড়ে। দম্ভের ফাঁদে পা দেয়। বিষাদগ্রস্ত হয়। বলে এই যেন কিছু একটা হল। এই যে আমি বিষাদগ্রস্ত হলাম। এর মানে আমি জ্ঞানী হলাম।
বাউল বলে, জ্ঞানী হলে। এবার বিজ্ঞানী হও। দম্ভ ছাড়ো। দরদে এসো। কোনো পাথরকে উপরে তুলতে হবে না সিসিফাসের মত। পাথরকে পাথরের মত থাকতে দাও। পাহাড়কে পাহাড়ের মত। প্রাণে অহেতুক আনন্দের ধারা আছে। এ মানুষে সে মানুষ আছে। তার কাছে এসো। দম্ভতে এসো না। ধুলোতে এসো। গড়াগড়ি দাও। দেখো কোনো পাথর কোনোদিন উপরে তোলার ছিল না। তোমার দম্ভ তোমায় ভুল বুঝিয়েছিল। তুমি হিসাবে ভুল করোনি। হিসাবের আঙিনায় ভুল করেছ। জগতজোড়া কি তোমার হিসাবের ব্ল্যাকবোর্ড গো? নোঙর তোলো। চলো ঘুরে আসি। সংসার থাক। তোমার দম্ভের সংসার থাক। তোমার হিসাবের সংসার থাক। তুমি এসো। আমার সঙ্গে এসো। আমি নিয়ে যাব। আমি তাকে চিনি। আমি তাকে দেখেছি। আমার সঙ্গে তার নিত্য আলাপ। চেতনা মানে তুমি বলো রোগ। কারণ তোমার ওইটুকুন বুদ্ধির কলমে, তুমি বিশ্বজোড়া স্লেটে আঁক কষতে চাও বলে। চেতনা মানে মধু। আনন্দ। চেতনা মানে মুক্তি। কী যে বলো তুমি, চেতনা মানে নাকি রোগ! বালাইষাট।
তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না? প্রথম প্রথম হবে না। ওগুলো পুরোনো অভ্যাসের জড়। তোমায় বিশ্বাস করতে হবে না। আবার জোর করে অবিশ্বাস করার ধকেও যেও না। কিছুতেই জোর কোরো না। জোর করাটা তোমার দম্ভের তাগিদ। এখানে জোর করাটা ব্রাত্য। এখানে কেন্দ্রকে খুঁজতে যেও না। এখানে সূত্রকে খুঁজতে যেও না। এখানে কেন্দ্র নেই। সূত্র নেই। সময় নেই। তাড়া নেই। এখানে শুধু আছে শুধু সহজ। সহজের কোনো কেন্দ্র হয় না। ঘাসের যেমন বাগান হয় না। সহজের কোনো সূত্র হয় না। ভূমির যেমন ভূমি হয় না। তুমি কেন খুঁজতে যাচ্ছ ওসব। তুমি আনন্দ। কারণ তুমি সহজ। তুমি চেতনা। কারণ তুমি সহজ। জগত জোড়া দম্ভের গোলে কঠিন। তুমি দম্ভ নও। দম্ভ তোমার বিকার। সহজ তোমার স্বভাব। সহজ থেকেই জন্মায় কঠিন। আবার সহজে এসেই সে মেলে। এই রহস্যকে বোঝো। সহজের ভূমি সহজ। কঠিনের ভূমিও সহজ। শুধু সে তার বোধে জন্মায় না। সে থাকে ভ্রমে।
আমাদের এখানে তাই বলে সিদ্ধ হলে সহজ হয়। আর পাশ্চাত্য বলে, সিদ্ধ হলে নাকি বিষাদগ্রস্ত হয়। বালাইষাট! এদিকে এসো। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের চাইতে বড় জিনিস সংসারে আছে। তাকে হেলায় হারাও কেন? সে হল মানুষের সত্য। সব সত্যের ভূমিই হল মানুষের সত্য। আর সেই মানুষের সত্যের গভীরে যে সত্য সেই হল সহজ। তাকে পাওয়া যায় না। যাকে পাওয়া যায় সে হল কঠিন। সহজকে পেতে গেলে সহজ হতে হয়। যেমন জলকে পেতে গেলে জল হতে হয়। সাগরের মধ্যে নুড়ি হয়ে লাভ কি? সে কোনোদিন মেশে না। সেই তার দম্ভ। সেই তার বিকার। কিন্তু এক বিন্দু জল, সাগরে মিশে সাগর হয়। সেই তার গতি। সেই তার সুখ। সেই তার কৃতকৃত্য হওয়া। এসো। দম্ভ থাক। তুমি এসো। এ মানুষের মধ্যে সে মানুষকে খোঁজো। সেই তোমায় সাগরে নিয়ে যাবে। তারপরে? আর বলা যায় না। যে বলবে সে মগ্ন তখন। দুনিয়া জুড়ে খেলাঘর বাঁধছে সে। তোমার হিসেবি ডাকে সাড়া সে দেবে কেন?