Skip to main content

ধর্মবোধকে জাগিয়ে তোলা, আর ধর্মবিশ্বাসকে উস্কানি দেওয়ার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। প্রথম কাজটা করেন কোনো আলোকপ্রাপ্ত পুরুষ; দ্বিতীয় কাজটা করেন সাধারণত কোনো উদ্দেশ্যদ্বারা চালিত মানুষ। সে উদ্দেশ্য রাজনীতি হতে পারে, জীবিকা হতে পারে, আরো কোনো গূঢ় স্বার্থ বা উদ্দেশ্য হতে পারে।

প্রাচীন ভারতের কথা থাক, রামকৃষ্ণদেবের কথায় আসি। তিনি বললেন না - তোমরা হিন্দু, একি করছ? তোমরা গেরুয়া রং পরে রাস্তায় ঘোরো, সেই নিয়ে স্কুলে-কলেজে গিয়ে হুজ্জুতি পাকাও, পুজোয়-উৎসবে মাতিয়ে দাও সবাইকে। বললেন না। তিনি বললেন, তোমার মধ্যে এক অনির্বচনীয় সত্য আছে, যাকে চেতনা বলে, তাতে স্থিত হতে পারলে তুমি শান্তি পাবে, তোমার মধ্যে থেকে ভয়, হিংসা যাবে। “সোনার তরবারিতে হিংসা হয় না”।

যিনি ধর্মবোধকে জাগাতে আসেন, তিনি মানুষের মধ্যে কোনো সীমানা তোলা প্রাচীর দেখেন না। বৈচিত্রতা দেখেন। এক-এক মানুষ এক-এক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। এই বৈচিত্রকে স্বীকৃতি দেন। কারণ তিনি বোধকে জাগাতে এসেছেন, কোনো বিশেষ রুচি বা মতকে নয়। যে সুরের বোধকে জাগাতে চায়, সে নানা বাদ্যযন্ত্রের বৈচিত্র দেখে সঙ্কোচ করে না বা দ্বেষ করে না। সে জানে সব যন্ত্রেই সেই সাতটা সুরই বাজবে, সুরের বিজ্ঞান একই, শুধু বাজানোর ধরণ আর বাদ্যের আওয়াজ পৃথক হবে। আর তাতেই সুরের সংহতি তৈরি হবে। এক যাত্রাওয়ালা এসেছেন রামকৃষ্ণদেবের কাছে, রামকৃষ্ণদেব তাকে বলছেন, দেখো, তোমাদের যাত্রার সময় নানা বাদ্যযন্ত্রে সুরের মিল থাকলেই তবে যাত্রা হয়, কিন্তু সবাই আলাদা আলাদা বাজালে যাত্রাই নষ্ট।

এই সংহতি তখনই সম্ভব যখন বোধের জাগরণ হয়। বোধ বৈচিত্রকে স্বীকার করে। অন্যদিকে বিশ্বাসের মধ্যে শুধুই বিরোধের ভয়। বিশ্বাস একটা মত, একটা উপায়। বোধ একটা জাগ্রত অবস্থা। ধর্মবোধ ইতিহাসের নানা সময়ে নিজেকে নানা ধর্মবিশ্বাসে বারবার প্রকাশ করেছে। কোনো বিশ্বাসই নিখুঁত, সম্পূর্ণ নয়। সেগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলে। তাকে আঁকড়ে ধরে থাকা শুধু বোধে অন্ধ হলেই সম্ভব। ধর্মবোধ মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম দিন থেকে আজ অবধি নিজেকে ক্রমে ক্রমে বিকশিত করছে। নইলে সেদিনের জঙ্গলের সভ্যতা থেকে আজকের দিন অবধি আমরা আসতে পারতাম না যখন আমরা 'হিউম্যান রাইটস' বলে একটা কিছু অবধি ভাবতে পেরেছি অন্তত। বলা হয় অহিংসা পরমধর্ম। এই অহিংসার বোধ মৈত্রী, ভালোবাসা, করুণা, ভ্রাতৃত্ববোধ --- এরকম নানা নামে সমাজে চলে আসছে। আমরা দিনে দিনে বুঝতে পারছি যুদ্ধ, হিংসা আমাদের কিছু ভালো দেয়নি। আমাদের যা কিছু ভালো তা দিয়েছে আমাদের মধ্যের এই অহিংসাবোধ।

সেদিন খ্রীষ্ট এসে যে কথাগুলো বলেছিলেন তার মূল সুর, বুদ্ধ যে কথাগুলো বলেছিলেন তারও মূলসুর এক। কেউ বলেননি যে হানাহানি কাটাকাটিতেই তোমাদের রাস্তা। এই বোধকেই ভাগবতে বলা হল 'ভাগবত ধর্ম'। প্রহ্লাদ তাঁর অসুর বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বলছেন, যদি মানুষে মানুষে, তথা জীবের প্রতি সম্মান প্রদর্শিত হয়, সেই হল শ্রেষ্ঠধর্ম।

তবে কি শাসন, শাস্তি, বিচার থাকবে না? থাকবে। কিন্তু সেটাই মূলসুর হবে না। সে আমাদের আদর্শ হবে না। সে হবে আমাদের প্রয়োজন। যে মানুষ দার্জিলিং-এ বেড়াতে যাচ্ছে, সে নিউ জলপাইগুড়ি থেকে গাড়িতে উঠছে, পাকদণ্ডী বেয়ে উঠছে, নানা সুবিধা অসুবিধার মধ্যে দিয়ে গিয়ে তার ভ্রমণকে সার্থক করছে, কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে তাকিয়ে বলছে, বাহ্! আসা সার্থক হল। এই কাঞ্চনজঙ্ঘাটাই হল আদর্শ, যা আমাকে এতটা রাস্তা নানা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সমস্যার সম্মুখীন হতে প্রেরণা জুগিয়েছে। মানুষের ধর্মবোধও তাই। 'ধর্ম' শব্দে যদি আপত্তি থাকে তবে এই ধর্মবোধের নতুন একটা শব্দ ইদানীং ব্যবহৃত হচ্ছে সেটাও ব্যবহার করা যেতে পারে, মনুষ্যত্ব। রামকৃষ্ণদেবের বিশ্বাসে চৈতন্যযুক্ত মানুষ শেষে সোনার মানুষ হয়। বিবেক-বৈরাগ্য যুক্ত মানুষ হয়। যে টাকার লোভ, অহমিকার দাপট সামলে মানুষ হয়। গীতার মতে যে তার প্রজ্ঞাকে স্থির করে, স্থিতপ্রজ্ঞ হয়, সেই মানুষ। মনুষ্যত্বের বর্ণনা দিতে গিয়ে প্লেটো বলেন, সাহস, সংযম, প্রজ্ঞা আর ন্যায়ের বোধ - এই হল মনুষ্যত্ব।

এখন বলুন তো কোন ধর্মবোধ মানুষকে এর বিপরীতটা শিখিয়েছে? কেউ শেখায়নি। তবে কি বলতে চাইছি রামকৃষ্ণদেব, খ্রীষ্টকে অন্ধের মত অনুকরণ করাই ধর্ম? না, কোনো মানুষই স্বয়ংসম্পূর্ণ না। যে কোনো মানুষের শিক্ষায় মুখ্য আর গৌণ --- দুটো দিক থাকে। আমাদের দরকার হয় তাদের উচ্চারিত সেই মুখ্য ধর্মবোধের দিশাকে অনুধাবন করতে চেষ্টা করা। "তোমার ঠাকুরত্ব না জাগলে কেহ তোমার কেন্দ্রও নয়, ঠাকুরও নয় – ফাঁকি দিলেই পেতে হবে তা" --- সত্যানুসরণের এই কথাটা যার জন্যে আমার ভীষণ প্রিয়।

কিন্তু এতো গেল ধর্মবোধের জাগরণের কথা। আজ যা চলছে সে হল ধর্মবিশ্বাসের জাগরণের কথা। আমার গেরুয়া, তোমার হিজাব; আমার রাম, তোমার রহিম; আমার দূর্গোৎসব, তোমার ঈদ; এ বিশ্বাসকে জাগিয়ে তুলে, এই নিয়ে 'তু তু ম্যায় ম্যায়' করে আখেরে কোনো লাভ নেই। কিন্তু সেটা আমরা বুঝি না। কারণ বোধের জাগরণে উত্তেজনা নেই, কোলাহল নেই, হাতেনাতে তপ্ত নগদ ফলাফল নেই। সে শিশিরপাতের মত শান্ত, স্নিগ্ধ। কোনো মহাপুরুষ থাকুন চাই না থাকুন, বলুন চাই না বলুন, মাধ্যাকর্ষণ যেমন নিউটনের বলার অপেক্ষা রাখে না, তেমনই আমাদের মধ্যেই মনুষ্যত্বের বোধ কি ধর্মবোধ কারোর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিবেকানন্দ'র ভাষায় সে চরম ঈশ্বরনিন্দার তুল্য। আমাদের শিক্ষা, আমাদের সমাজ যদি এই বোধকে জাগ্রত করার দিকে এগোয়, যদি সেই সৎসাহসটা আমরা দেখাতে পারি, তবে প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে অধুনা রামকৃষ্ণদেবতুল্য সকল মহাপ্রাণ আমাদের দু'হাত তুলে আশীর্বাদ করবেন, আমরা কোনো ধর্মবিশ্বাসে বিশ্বাসী না হলেও। নইলে রামকৃষ্ণদেব “তোমাদের চৈতন্য হোক” বলে জগৎ ছাড়তেন না। এই চৈতন্যই তো ধর্মবোধ, মনুষ্যত্বের বোধ।