বোষ্টুমি (এ বানান অভিধানে নেই, জিভেতে আছে) এসে দাঁড়ালো দরজায়, নামগান শুনতে পাচ্ছি। বোষ্টুমির গায়ে গেরুয়া শাড়ি। কপালে চন্দন। কালো মুখের মধ্যে খোদা দুটো পোড় খাওয়া চোখ।
বাগানে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা চাইবে। রাধা-কৃষ্ণের নামে ভিক্ষা চাইবে। তাকে টাকা দিতে বিরক্ত হব, মনে হবে অপচয়, মনে হবে এমন সুস্থ সবল শরীর, ঠকাও কেন? তবু দেব, কারণ বচসা করতে ভালো লাগবে না। পূজোর মাস, হাতে দুটাকা নিয়ে ভাবছি, বোষ্টুমি চাইবে শাড়ি, দেব না। কেন ঠকাবে? দিলাম পয়সা হাতে, সে মাথায় ঠেকিয়ে বলল, "আসি ভাই!” কি সুরে বললে এ কথা!
সুরের মধ্যে ব্যথা। উদাস ব্যথা। খোঁচ লাগল, ফিরে তাকালাম চোখের দিকে। সজল চোখ, যেন সদ্য একটানা বৃষ্টির পর পাতায় পাতায় বিন্দু বিন্দু জল। জিজ্ঞাসা করলাম না, কি হয়েছে তোমার? জিজ্ঞাসা করতেই পারতাম, কিন্তু সংসারে কিছু ব্যথা আছে, যাকে ভাষা দিতে গেলে মনটা বিষিয়ে ওঠে। সে ব্যথাকে ধীরে ধীরে সইয়ে নিতে হয়, মানিয়ে নিতে হয়, মিশিয়ে নিতে হয়। বোষ্টুমির চোখে সেই ব্যথা। বোষ্টুমি বুঝল, আমি বুঝলাম। মানুষের চোখে উপর পর্দা, সে পর্দা আরেক চোখের চাহনিতে উড়ে যায়, বোষ্টুমি আবার বলল, আসি ভাই।
বোষ্টুমি ফিরে গেল। সাথে গেল আমার দু’টাকা। ভিক্ষা বলি যাকে। কিন্তু বোষ্টুমি আমাকেও একমুঠো ভিক্ষা দিয়ে গেল। আমার কিছু ব্যথার নীরব ভাষা। ওর চাহনিতে। সে চাহনি আর সে কন্ঠস্বর আমার ঘরের কোনায় কোনায় আমার সাথে লেগে রইল খানিক। মানুষ ভাষায় বলে না, সুরে বলে। মানুষ সুরে বাঁচে, সেই রবি বাউল বলে গেল না, কথাটা মানুষের প্রয়োজনের, আর সুরটা অপ্রয়োজনের। নিজের মধ্যে যে আমিটাকে কারোর প্রয়োজন নেই, অথচ যাকে হেলা করলে নিজের কাছেও নিজের প্রয়োজনটা ফুরাতে শুরু করে সে এসে আমার সামনে বসল। এমন আগেও হয়েছে।
চলন্ত ট্রেন। গিজগিজ করছে মানুষের দরকারি কথাবার্তা, ঠাট্টা-ইয়ার্কি। হঠাৎ কোনো বাউলের একতারায়, অমধুর কন্ঠস্বরে বাজল এমন একটা সুর যা সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে গেল, সব কোলাহল ছাপিয়ে বাইরের সরে সরে যাওয়া গাছ, মাটি, বাড়িঘরগুলো এমন স্পষ্ট হয়ে উঠল, মনে হল এই তো আমি আছি, মাটির টানেই আছি। সে ভিখারি আমায় ভিক্ষা দিয়ে গেল। সে বলে গেল, ফেরো... ফেরো... ফেরো...
কোথায় ফিরব? জানি না। কোনো দর্শন না। কোনো উদ্দেশ্য না। কোনো উচ্চ আদর্শ না। কারোর কাছেও না। সে ফেরার খবর আছে বাউলের কাছে। সে ফেরার খবর আছে ভিক্ষার ঝুলির কাছে। সে ফেরার খবর আছে আগুনের কাছে, জলের কাছে, আকাশের কাছে, মাটির কাছে। সব অপ্রয়োজনের কাছে।
কাজ, দায়িত্ব, চালাকি, ফাঁকি এরা সব একের সাথে একে অঙ্গাঙ্গি জড়িয়ে। কাউকে ছেড়ে কারোর থাকার যো নেই, যদি না সে মানুষটা মাঝে মাঝে ফিরতে পারে। সব কাজের ভাষা ভুলে, সুরের ভাষায় ডুবতে পারে। রবীন্দ্রনাথ বলেন - যে নোবেল পেয়েছে, যার বিশ্বজোড়া খ্যাতি, যে ইংরাজিতে কথা বলতে পারে, সে স্যার রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু যে লেখে সে নিতান্তই রবীন্দ্রনাথ। বাঙালির একটা বড় ফেরা তার রবীন্দ্রনাথের কাছে ফেরা। রবীন্দ্রনাথই একমাত্র সে, যে তাকে না বুঝিয়েও বোঝাতে পারে। যে তাকে তার ফেরার পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
তাই ভিক্ষা চাই। একমাত্র ভিক্ষাতেই সে ফেরার টান। উপার্জনে না। উপার্জন খুব বড় জিনিস, কিন্তু পরম জিনিস নয়। কাজের মানুষ, আত্মাভিমানী মানুষ আমায় বকা দেবে, বলবে, কি অলুক্ষুণে কথা বাপু তোমার! তাকে প্রণাম জানিয়েই বলি, দাদা আমি সে অকর্মণ্যের ভিক্ষার কথা বলছি নে, আমি বলছি সে ভিক্ষার কথা, যে ভিক্ষা সব কাজ হারালে আসে না, যে কাজি হারালে আসে। যে কাজ করবে সেই আর নাই, তার আর কাজ কই বলো। তুমি বলবে একি হেঁয়ালি কথা বাপু তোমার। আমি বলব, দাদা আজ বরং থাক, যেদিন তোমার পোশাকে লাগবে আশ্বিনের ঝড় সেদিন না হয় তুমি বুঝো। আজ সে তর্ক থাক।
আমার পরম বিপদ তাই সেইদিন যেদিন আমার ভিক্ষাপাত্র যায় চুরি। চুরি করে আমার অভিমান, আমার উপার্জনের অভিমান। সেদিন নিজেকে একটা মস্ত মানুষ বলে বোধ হতে শুরু করে, মনে হয় আমায় ছাড়া এই জগত সংসার চলবে কি করে? আমায় একটা মস্ত কাজ করতে হবে, আমি যে ধরাধামে এসেছি সে কথাটা যো সো করে সবাইকে বোঝাতেই হবে। যত বেশি এ চিন্তা চাপে, তত অহং মদ ওঠে গেঁজিয়ে, বুদ্ধি হয়ে ওঠে বল্গাহীন। উপনিষদের ঋষি বলে ওঠেন, "তোমার রথ চলেছে ঊর্দ্দ্বশ্বাসে, সে রথের সারথি কই? তোমার বিবেক কই?” কিন্তু সে কথা শোনার আমার সময় কই তখন? রথের ঘড়ঘড় আওয়াজ যত ওঠে, আমার অহং তত ওঠে নেচে, রথের চাকার ধুলো যত ওড়ে আমার অহং তত বলে ওঠে এই... এই... এই তো চাই...
এমন সময় বোষ্টুমি এসে দাঁড়ায় দরজায়, হাতে তার ভিক্ষাপাত্র। মনের ভিতর প্রাচীন ভিখারি ওঠে কেঁদে। অপুষ্ট, চীরবাস নিয়ে সে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়, বলে আমায় মুক্তি দাও... আমি ভিক্ষায় যাই.... তোমার চিত্ত গিয়েছে অভিমানের বিষাক্তবাষ্পে ভরে... তুমি ভুলেছ তোমার ভিক্ষাপাত্রের কথা... তুমি ভুলেছ এ সংসারে আমরা সবাই ভিখারি... পরম যা কিছু পাই তা ভিক্ষা হিসাবেই পাই... এ ভুললে পরম বিপদ......