আমি
-------
ছোটবেলা থেকেই সমুদ্রের ধারে যাচ্ছি। চামচে, ভাঁড়ে, আধখানা ডাবের খোলায় জল ধরে ধরে রাখছি। যত বড় হচ্ছি পাত্রের পরিমাণও বাড়ছে। হাড়ি, কলসী, ড্রাম - যাতে পারছি জল জমিয়ে জমিয়ে রাখছি। বড় হওয়ার সাথে সাথে জল আনার কৌশলও বদলেছে। আগে ছিল সহজ সরল কৌশল, এখন হয়েছে জটিল থেকে জটিলতর। জমিয়েই যাচ্ছি, জমিয়েই যাচ্ছি। খেলা ভুলেছি, বেড়ানো ভুলেছি, দিগন্তের দিকে চাইতে ভুলেছি। সমুদ্রে আসা নতুন নতুন নদীর পরিচয় নিতে ভুলেছি। শুধু জল জমানোর নেশা এখন।
সব জমানো জল নেই অবশ্য এখন। কিছু পাত্র পড়ে গেল, কিছু জল শুকিয়ে গেল অলক্ষ্যে। ঝড়ে ভাঙল কিছু পাত্র, কিছু ভাঙল এর ওর হাতে লেগে।
জলভরা পাত্রর সারি আমার চতুর্দিকে। হাঁটতে চলতে পা বেধে যায়। সমুদ্রে স্নানে যাব কি করে?
চারিদিকে কাঁকড়াগুলো যখন বালির তীরে উঠে আসে দল বেঁধে, অন্যমনস্ক হই। মনে হয়, আমারও ওরকম দল বেঁধে একসাথে থাকার কথা ছিল তো। চোখ পড়ে আমার জমানো জলের নিজের তৈরী জলাশয়ের দিকে। মায়া লাগে। মোহ জন্মায়। এই ক্ষুদ্র জলাশয়, ওই অসীম সমুদ্রের থেকে অনেক বেশি সত্যি যে আমার কাছে!
বন্ধনে নিরাপদ লাগে, মুক্তিকে ভয় করি! এ বিশাল সমুদ্র যেন সারাদিন ষড়যন্ত্র করছে, ফুঁসছে আমার এই নিজের হাতে গড়া জলাশয়কে ভেঙে গুঁড়িয়ে তছনছ করবে বলে। প্রতিটা ঢেউ এর সড়সড়ানি আওয়াজে শুনতে পাই, সেই ষড়যন্ত্রের ফিসফিসানি।
মনে হয় সম্পূর্ণ সমুদ্রটাকে কোনো যাদুবলে যদি স্থির করে দিতে পারতাম, আহ! বাঁচতাম তা হলে। ঘুমাতাম নিশ্চিন্তে আমার সাম্রাজ্যে একা সর্বাধীশ্বর হয়ে। হচ্ছে না... হচ্ছে না... হচ্ছে না। ক্ষেপে উঠছি, ভীষণ ক্ষেপে উঠছি।
জানি আমার তৈরী এ জলাশয়ের জল ও সব নেবে। সূর্য শুষে নেবে নিষ্ঠুরের মত, ঢালবে সমুদ্রের বুকে।
সমুদ্র
--------
সেদিন ভোরবেলা ভাবলাম আর না, দিই সব জল ওর বুকে ঢেলে। সব হারিয়েই না হয় শান্ত হই!
গেলাম সমুদ্রের কাছে। সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, নাও আমার সব কিছু, ভয়ে ভয়ে আর তো বাঁচতে পারি নে!।
ফিরিয়ে দিল। হ্যাঁ হ্যাঁ, এই বিশাল অনন্ত সাগর আমায় ফিরিয়ে দিল।
সে বলল, তোমার এখনো সময় হয় নি! জল না, আমার চাই তোমাকে। ও জল তো আমারই।
চমকে উঠে বললাম, আমায়! আমায় নিয়ে কি করবে?
সমুদ্র বলল, যেদিন তা বুঝবে সেদিন দেখবে তোমার গা আমারই মত নোনতা... আমিই তুমি... তুমিই আমি...