বাস্তবতা আর ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। ধরা যাক আমার শরীরে কোনো রোগ ধরা পড়ল। সেটা ঘটনাপ্রবাহ। কিন্তু সেই রোগের সঙ্গে আমি কিভাবে লড়ব, সেটা আমার বাস্তব। বাস্তবটা ব্যক্তিগত। ঘটনাপ্রবাহ নৈর্ব্যক্তিক। একই ঘটনাপ্রবাহে এক একজনের বাস্তবটা এক এক রকম হয় তাই। বাস্তবটা সাবজেক্টিভ। ঘটনাপ্রবাহটা অবজেক্টিভ।
লাভ-ক্ষতি, সুখ-দুঃখ সাবজেক্টিভ। ভীষণভাবে বাস্তব। কিন্তু এগুলো যে যে ঘটনাপ্রবাহজাত, সেগুলো অবজেক্টিভ। নৈর্ব্যক্তিক। আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। এই পার্থক্যটা দেখেই হয় তো ভারতীয় দর্শনে একদিন পুরুষ - প্রকৃতির ধারণা হয়েছিল। পুরুষ সাবজেক্টিভ। প্রকৃতি অবজেক্টিভ। পুরুষ ভোক্তা। প্রকৃতি নিত্য ঘটমানা। আরো বলা হল, এই দুই-ই নিত্য। পাশ্চাত্যের স্টোয়িক দর্শনও তার মত করে এই দুটো করে আলাদা করে বলতে চাইল, নির্বিকার থাকো। নিরাসক্ত থাকো। বাস্তব হোক পুকুরের স্থির জলের মত। ঘটনাপ্রবাহ হোক তার উপর অবিরাম বয়ে চলা ধারাবাহিক প্রতিচ্ছবির মত।
বলা সোজা। ভাবা সোজা। কিন্তু জীবনে রূপদান করা কঠিন। কঠিন মানে যতটা সিরিয়াসনেস, সময় আর মনোযোগ লাগে, আমি আমার স্বাভাবিক রুচি অনুযায়ী দিতে রাজি নই। যতক্ষণ না বাধ্য হচ্ছি। মরমী সাধক বললেন, ‘'জিন্দেগী কি ভোগ হি ভোগতে সবকো হোয়ে / জ্ঞানী ভোগত জ্ঞান সে, মূরখ ভোগত রোয়ে।”
ঘটনাপ্রবাহ আর বাস্তবতার এই পার্থক্যটা, বা আরো ভালো ভাষায় বললে দ্বন্দ্বটা পশুদের নেই। তাদের সবটাই ঘটনাপ্রবাহ। সে নিজেও। সে বর্ষা নিয়ে অভিযোগ করে না। মাথার ঘা নিয়ে অভিযোগ করে না। কষ্টে কাঁদে। অন্য সময় স্ফূর্তিতে বাঁচে। মরবার সময় অনায়াসে মরে।
মানুষের সে ভাগ্য নেই। যত বুদ্ধিমান হয়, যত চিন্তা সুক্ষ্ম হয়, তত তার মধ্যে এই পার্থক্য প্রবল হয়। সে ঘটনাপ্রবাহর চাপে মরে না। নিজের বাস্তবতার চাপে মরে। আসন্ন বিপদ, আসন্ন মৃত্যুকে অনুমান করে। ভয় পায়। আশঙ্কিত হয়। ছটফট করে। প্রার্থনা করে। আরো এটা সেটা করে। অবশেষে মরে যায়। বাস্তব শূন্য হয়। ঘটনাপ্রবাহ চলতেই থাকে।
এ অভিশাপ। আবার এই আশীর্বাদ। একটা তার এনে যদি কেউ বলে, এতে সুর তোলো তো দেখি। অরসিকের কাছে সে এক আপদ। কিন্তু সুর রসিকের কাছে সে এক সাধনা। চ্যালেঞ্জ। সে ধাতুতে সুর তুলবে।
দ্বন্দ্ব না থাকলে প্রাণ অসাড়। প্রাণ অসাড় হলে আমি অসাড়। রবীন্দ্রনাথের “ঝুলন” কবিতাটা মনে করা যাক। কেন হঠাৎ নিশীথরাতে অমন মরণখেলা খেলবার ইচ্ছা হল? কারণ প্রাণ অসাড় হয়ে এসেছিল। সুখের আলসে।
কিন্তু আমি তো রবীন্দ্রনাথ নই। আমার সে টেম্পারামেন্ট নেই। মানুষে মানুষে পার্থক্য তো এই টেম্পারামেন্টে। টেম্পারামেন্ট তৈরি করে বাস্তবতা, ঘটনাপ্রবাহ ছেঁচে। কেউ কাঁদে। কেউ হাসে।
উপায় কি? গোটা সংসার এর একটাই উপায় চিরটাকাল বলেছে - বৈরাগ্য। রাগ মানে রঙ। রঙ লাগুক, কিন্তু কোনো রঙই পাকা হতে দিও না। কিন্তু সংসারে আমার যে এত অনুরাগ? উত্তর এলো, ভালো তো। যদ্দিন অনুরাগের সুখে হাসছ, অনুরাগের তাপে কাঁদছ, চালিয়ে যাও না ভাই। কেউ বারণ করেনি। কিন্তু যদি কোনো সময় মনে হয়, আর তো ভাল্লাগছে না। কিম্বা এমন একটা আঘাত খেলে যে এ খেলা থেকেই মন উঠে গেল, তখন শুনবে ঘটনাপ্রবাহ আর বাস্তবতার ফাঁক দিয়ে আসা এক টুং টাং একতারার সুর। ডাকছে তোমায়। কান পেতে কবি শোনে, “ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কি সঙ্গীত ভেসে আসে…. কেন কারাগৃহে আছিস বন্ধ, ওরে ওরে মূঢ়, ওরে অন্ধ, ভবে সেই সে পরমানন্দ, যে আমারে ভালোবাসে/ কেন ঘরের ছেলে পরের কাছে পড়ে আছিস পরবাসে”।
একি মিছে সান্ত্বনার কথা? ফাঁকা আশার কথা? না হে না। তীর থেকে তরী ভাসালে বোঝা যায় সাগর শুধু ডোবায় না, ভাসায়ও। ডোবার ভয়ে এতদিন যে তীরে তীরে কাটালাম, সে ভয়টুকুর আসলেই কোথাও কোনো অস্তিত্ব নেই। প্রতিদিন চিতায় লক্ষ মানুষ পুড়ছে, প্রতিদিন মাটিতে লক্ষ মানুষ কবরে যাচ্ছে…. আমিও যাব। ভয়ে চোখকান বন্ধ করে রাখলেই কি রক্ষা পাব? কবি গাইছেন, “দুদিন দিয়ে ঘেরা ঘরে তাইতে যদি এতই ধরে, চিরদিনের আবাসখানা সেই কি শূন্যময়, জয় অজানার জয়/ কেন রে এই দুয়ারটুকু পার হতে সংশয়, ও তোর পার হতে সংশয়”।
(ছবিঃ Debasish Bose)