Skip to main content

        যে কোন ism বা -বাদ এর সুবিধা হল, সে একটা করিডোর ভিসন বা টানেল ভিসন দেয়। যেমন নারীবাদীর দৃষ্টিভঙ্গীর মজা হল সংসারে আশেপাশে যাই ঘটুক না কেন, তাকে অন্যান্য যে কোনো দৃষ্টিভঙ্গীতেই দেখা যাক না কেন, তার ব্যাখ্যা একটা নির্দিষ্ট দিকেই গড়াবে, একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গীতেই হবে। যা কিছু সামগ্রিকতাকে বাদ দিয়ে হয়, সে যতই মনোগ্রাহী, সুযুক্তিসম্পন্ন হোক না, তা খুব একটা ফলপ্রসূ হয় না, কারণ তা একপেশে, অর্ধসত্য। তাই যে কোনো ইজম তথা বাদ-ই অর্ধসত্য। সে এক বিশেষ গোষ্ঠীর। তা যতটা না বিরোধের বিষয় হয়, তার তুলনায় খুব সামান্যই সে কোনো সামগ্রিক সুদূরপ্রসারী সমাধানের আলো দেখাতে সক্ষম হয়। কিন্তু মুশকিল হল, সেই সামগ্রিক চেতনার বিকাশের কথাটা এতবার বলা হয়ে গেছে, তার পরিভাষাগুলো এত ক্লিশে হয়ে পড়েছে যে তার আবেদন আর মস্তিষ্কের কোষে পৌঁছায় না, যতক্ষণ আমরা শুধুমাত্র বুদ্ধিবিলাসী হয়ে থাকি। অর্থনীতিবিদ অশোক মিত্র একটা প্রবন্ধে এককালে কিছু উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ যুবকের গণ-আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার কথা বলতে গিয়ে একদম শেষে বলছেন, "বর্তমান প্রজন্ম বড়জোর বিস্ময় প্রকাশ করবে, এই সম্পন্ন ঘরের ছেলেগুলির কি মাথা খারাপ হয়েছিল যে মার্কিন এইচ-ওয়ান, এমনকি খোদ ও-ওয়ান ভিসার জন্য চেষ্টা না করে বাউন্ডুলে ভ্যাগাবন্ডদের দিকে নাম লেখাল"। 
        এই বুদ্ধিবিলাসীতার সাথে যে শব্দটার খুব ঘনিষ্ঠতা তা হল বৌদ্ধিক-অসততা, ইন্টেলেকচ্যুয়াল ডিজনেস্টি। তাকে নানা যুক্তি খাঁড়া করতে হয়, কারণ নিজেকে বোঝানোর চাইতে পাড়াকে বোঝানোর দায় অনেক। ইংরাজীতে যাকে স্মাগনেস বা চূড়ান্ত আত্মতুষ্টির অনুভব বলে কোনো কিছুর প্রাপ্তিতে বা সফলতায়, তা বেশিদিন থাকে না, তারপর নিজের অবস্থান বোঝানোর একটা দায় এসেই পড়ে, সেই দায় থেকেই তৈরি হয় এমন একটা বৌদ্ধিক অসততার দর্শন, নানা গালভরা প্রতিশব্দ, নানা পোস্টট্রুথের আমদানী ইত্যাদি ইত্যাদি। "যদিও আমি মাকু, তবু কেন আমার সন্তান মার্কিনী? আসুন বোঝাই"..."যদিও আমার মাতৃভাষা অন্তঃপ্রাণ, তবু কেন আমার সন্তান পরভাষায় শিক্ষাজগতে তার কচি পা রাখল? আসুন বোঝাই"... বোঝায় যত বোঝা বেড়েই চলে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়। একে বৌদ্ধিক অসততা বলছি। যার মূলেও সেই একটা ইজম এর প্রতি ছদ্ম-আনুগত্যের ভাব। 
        আচ্ছা, যদি এই ইজম সরিয়ে দেওয়া যায়, তবে কি আমাদের মুখোশগুলো খানিক আলগা হতে সুবিধা হয়? আমরা একটু বেশি করে নিজেদের অবস্থান নিয়ে জটিলতা মুক্ত হই? কেউ কেউ বলবেন তবে তো দেশে আদর্শ বলে কিছুই থাকবে না! মানলাম থাকবে না, কিন্তু কথাটা কি আরেকটু গভীরে ভেবে দেখা যায় না? আদর্শ বলে কিছু থাকবে না, না আদর্শের গরিমা বলে কিছু থাকবে না? দুটো এতই কাছাকাছি যে তাদের আলাদা করা শক্ত। 
        যে আদর্শের প্রতি আন্তরিক টানে আদর্শের কাছে আসে তাকে ভানের সাহায্য নিতে হয় না, কিন্তু যে আদর্শের গরিমার টানে আসে, সে গরিমা নিজের কাছে নিজের হোক কি পাড়াপ্রতিবেশীর কাছে, তাকে নিয়েই যত গোল। সেই নিজেকে নিয়ে ধন্দে পড়ে। এদের এককালে আমাদের দর্শন বলতে চেয়েছিল - সংকর। অর্থাৎ মনে ভাব এক, কিন্তু চেষ্টাটা আরেক পথে। এদের সংখ্যাটাই সংসারে বেশি, তাই গোলোযোগের আওয়াজটায় আমরা এত অভ্যস্ত হয়ে পড়ি যে, যে মানুষটা নিঃশব্দে কাজ করছে, পরতে পরতে ব্যাখ্যা করছে না, তার মুখের দিকে তাকিয়ে সংশয় প্রকাশ করি, বলতে চাই, "ওহে তুমি খাঁটি তো? তুমি চেঁচাচ্ছ না কেন? তোমার কি আত্মবিশ্বাসের অভাব?” সে যখন সেই কথাগুলোতেও কোনো প্রতিবাদ জানায় না, তখন একপক্ষ তাকে বলে, দাম্ভিক, আরেকপক্ষ বলে, মূর্খ। 
        তাই বলছিলাম যে, যদি সব আদর্শগুলো সরিয়ে রাখা যায়, সব ইজমগুলো ভুলে থাকা যায়, তবে কিসের উপর মানুষ দাঁড়াতে পারে আবার? এইবার আমি আবার একটা বাজে প্রশ্ন করব। আমাদের চিন্তা মানুষকে দাঁড় করাতে না আমাদের চিন্তা মানুষকে নিয়ে জোট বাঁধতে? দল পাকাতে? শেষেরটাই অবধারিতভাবে বেশি সত্যি। মা চান ছেলেটা বাঁচুক, বাবা চান ছেলেটা দাঁড়াক। প্রথমটা জীবজ দাবি, প্রকৃতি এর সহায়। পরেরটা বুদ্ধিজ, মানুষের তৈরি সংজ্ঞা, তাই এক্ষেত্রে হতাশা, অবসাদ, ব্যর্থতা। কারণ দলভুক্ত করা গেল না। কিসের দলভুক্তি? না সফলদের তালিকায়। কাকে সফল বলে? কানে আঙুল দিন, এখনই একটা বোমা ফাটবে, আর সেই বোমা থেকে টুকরো টুকরো সফলতার সংজ্ঞা আপনাকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলবে। 
        আমাদের শিক্ষা, ধর্ম, রাজনীতি - এর একটা বড় উদ্দেশ্য দলগঠন, শ্রেণীগঠন। তার বাইপাস, মানুষ গঠন। যতক্ষণ না এই অভিমুখ বদলাচ্ছে, যতক্ষণ না একটা মানুষ স্বাধীন বৌদ্ধিক প্রাণনায় নিজেকে চিনছে, ততদিন এ স্বচ্ছতা আসা অসম্ভব। যেদিন সে সেই বিকাশের মাটিতে এসে দাঁড়াবে, সেদিন সে বুঝবে তাকে সহানুভূতিসমন্ন হতে হবে না, কারণ সহানুভূতি শব্দটা অহংকারি ড্রয়িংরুমজাত, সে আপনি সহমর্মি হয়ে উঠবে, কারণ সহমর্মিতা মায়ের হেঁসেলের শব্দ, যেখানে মেনু কার্ড পৌঁছানোর আগে সন্তানের খিদের বার্তা পৌঁছায়। সেদিন সে দলের সদস্য না, গোটা একটা মানুষ।