সৌরভ ভট্টাচার্য
27 April 2018
“Asaram believed that sexual exploitation of girls is not a sin for 'Brahmgyani' or a highly enlightened person”
আসারাম নিজেকে বিশ্বাস করত যেহেতু তার 'ব্রহ্মজ্ঞান' হয়েছে তাই একটা কিশোরী বা যে কোনো কাউকে ধর্ষণের অপরাধ তাকে স্পর্শ করতে পারে না।
আমার কথাটা শুনে খটকা লাগল। আলোচনা এগোনোর আগে, আসুন দেখে নেওয়া যাক দুটো ব্রহ্মজ্ঞানের উক্তি। গীতা আর কথামৃত থেকে।
১) “আমি কর্তা এই অভিমান যাহার নাই এবং যাহার বুদ্ধি কর্মফলে লিপ্ত হয় না, তিনি জগতের সমস্ত প্রাণী হত্যা করিলেও হত্যাকারী হন না, বা হত্যাক্রিয়ার ফলে বধ্য হন না” – গীতা ১৮ অধ্যায়, শ্লোক ১৭
২) গোপীরা যমুনা পার হতে পারছেন না। এমন সময় ব্যাসদেব সে পথে এলেন। গোপীরা তাকে ধরলেন যমুনা পার করিয়ে দিতে। তিনি বললেন, আগে তোমাদের সাথে কি আছে আমায় খাওয়াও। গোপীরা ননী খাওয়ালো। তিনি খেয়েদেয়ে যমুনাকে বললেন, হে যমুনা যদি আমি কিছু না খেয়ে থাকি তবে তুমি দু'ফাঁক হও। যমুনা দু'ফাঁক হল। গোপীরা হেঁটে চলে গেলেন। কিন্তু উনি যে অত ননী খেলেন? উনি খাননি তো, উনি তো ব্রহ্মজ্ঞানী। তাই উনি শুদ্ধাত্মা। পাপ-পুণ্যের পার। - এটা কথামৃতের তত্ত্ব।
এই হল মোটামুটি ব্রহ্মজ্ঞান হলে কি কি বেনিফিট পাওয়া যায় তার আউটলাইন। কথা হচ্ছে, আমার এই ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছে কি না কে নির্ধারণ করবে? কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোনো পরীক্ষা পদ্ধতি তো নেই। আমি আসারামের বহু প্রবচন শুনেছি সংস্কার টিভিতে। লোকটার বলার একটা আকর্ষণী ক্ষমতা ছিল। নইলে অতগুলো মানুষ তার বাকচাতুর্যে বিমোহিত হবেই বা কেন? আর তারা যে সব অশিক্ষিত আকাট মুখ্য তাও তো নয়। তারা যথেষ্ট পড়াশোনা জানা সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব সব। আর সাধারণ মধ্যবিত্ত অগুনতি মানুষ তো আছেই। কথামৃতে আছে, ‘যাকে অনেক লোক মানে গণে তার মধ্যে নিশ্চই কিছু ঈশ্বরের ক্ষমতা আছে।‘ সেই অর্থে আসারামের মধ্যে ঈশ্বরীয় গুণ আছে সন্দেহ নেই।
তো কথা হচ্ছিল ব্রহ্মজ্ঞান নিয়ে। কেউ কি করে বুঝবে তার ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছে? এ বলা খুব কঠিন। তবে বেদান্ত দর্শনে এই হল সাধনার চূড়ান্ত অ্যাচিভমেন্ট। এরপরে শুধু ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে ঘোরা। আমি যখন প্রচণ্ড শাস্ত্রচর্চা করছি, প্রায়ই মঠে যাচ্ছি কিশোর তথা যৌবনের প্রথম বেলায়, আমারও প্রায়শই ধারণা হত আমারও বুঝি ব্রহ্মজ্ঞানের মত কিছু একটা হচ্ছে। কারণ বেদান্ত, স্বামীজি, কথামৃত ইত্যাদি গোগ্রাসে গিলছি। ভাবছি ব্যাপারটা হেবি ইজি। ব্রহ্মজ্ঞান বেশ একটা ‘কুল’ থাকার অবস্থা। নো টেনশান ডু ফুর্তি। কারণ তখন নাকি চারদিক আনন্দই আনন্দ। কারোর উপর কোনো আসক্তি রাখা চলবে না, ইজি লাইফ হতে হবে, কোনো ঝুটঝামেলায় থাকা চলবে না, সবসময় মনে করতে হবে জগতে যা হচ্ছে সব মায়া – ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা। সব মায়া, মিথ্যা। একমাত্র সত্য ঈশ্বর। তাতে মন লাগিয়ে রাখতে হবে সবসময়। মনকে তীর করো, ওঁকারকে ধনুক করে এক্কেবারে সটান ব্রহ্মে গিয়ে মিশে যাও। তবে এই কাম-ক্রোধের বিকার? এসব তো মায়া, সংস্কার। আসবে যাবে। এ সব নিয়ে মাথা ঘামাবে কেন? ওগুলো সংস্কার বশে আসবে, চলে যাবে। এই দেশ-কাল ইত্যাদি মানুষগুলো আদতে মুক্ত আত্মা। শরীরটা শুধুই পোশাক। ও নিয়ে অত ভাবাভাবির কি আছে?
ফলে একটা নির্মম আত্মকেন্দ্রিক জীবন-দর্শনের সূত্র গেঁথে দেয় এই ব্রহ্মজ্ঞানের লক্ষণের বর্ণনাগুলো। আমি এমন পরিবারও দেখেছি তারা সবাই দীক্ষিত, বাড়ির কেউ কারোর সাথে ভালো করে কথা বলে না, পাড়ায় মেশে না, কারণ ওতে মন ব্রহ্মের স্থিরতা থেকে চ্যুত হবে। ঠাকুর বলেছেন, যে মন ঈশ্বরে দিবি সে মন একে তাকে দিয়ে নষ্ট করা কেন? দই পেতে সংসারে আসতে হবে, হাতে তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙতে হবে। অর্থাৎ যাই হোক না কেন, নিজেকে সংসারের মধ্যে জড়ালে চলবে না, নিজেকে ঈশ্বরের চিন্তায় ডুবিয়ে রাখতে হবে।
এই দর্শন যে মানুষকে কতটা আত্মকেন্দ্রিক করে তুলতে পারে তা নিজের চোখে দেখেছি বলেই জানি। এই ব্রহ্মজ্ঞানের দোহাইয়ে আজ একটা আসারামে ভারত কেঁপে উঠছে, ভালো করে তাকিয়ে দেখলে এই ব্রহ্মচিন্তার উদাসীনতা যে আমাদের কতটা ক্ষতি করে আসছে যুগ যুগ ধরে ভাবতে গেলে ভিরমি খেতে হয়। একটা জাতের নৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে বসে আছে এই দর্শন। নির্লিপ্ত থাকো, উদাসীন থাকো। সাধারণ অনুকম্পা, সাধারণ ভালোবাসার গলা টিপে একটা কৃত্রিম জগতের প্রতিশ্রুতির মোহে আটকে রেখেছে যেভাবে যুগ যুগ ধরে ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। আমি আগেও বলেছি, আজও বলছি, একটা মানুষকে ঈশ্বর জেনে সেবা করার মত বাণীটা আমি বুঝিনি। যে ঈশ্বরকেই মানুষ চোখে দেখল না, জানল না, তাকে নাকি ভালোবাসতে হবে একটা মানুষের যাবতীয় মনুষ্যোচিত বৈশিষ্টকে সরিয়ে। কারণ আমার প্রায়োরিটি ঈশ্বর, মানুষ না। আমাকে প্রত্যেকটা জীবকে অবিনশ্বর, কামনা-বাসনারহিত ঈশ্বর সত্তা ভাবতে হবে। কিন্তু ঈশ্বরের কি খিদে-তেষ্টা-কাম-দুঃখবোধ থাকে? তবে কি ঈশ্বররূপী মানুষ অভিনয় করছে? একই সাথে বলছি জীবই শিব আবার বলছি জীবের দুঃখ দারিদ্রতার কথা – কিরকম সোনার পাথরবাটি টাইপের কথা হয়ে যাচ্ছে না? তাই সেবাও হল না, মানবিক স্বাভাবিক প্রেমও হল না। একটা দরকাঁচা টাইপের কিছু হল। আমায় গালাগাল করার আগে নিজের কমোন সেন্সকে একবার প্রশ্ন করে নেবেন, এই হেঁয়ালি আপনি বুঝেছেন কি? যদি বুঝেছেন তো আপনাকে অজস্র অভিনন্দন, আমি বুঝিনি। বরঞ্চ সবাই ঈশ্বরের সন্তান, তাদের সেবায় ঈশ্বর তুষ্ট হন, এটা বুঝি। বা ঈশ্বর প্রেমে জীবের সাথে এসে লীলা করছেন, এটাও বুঝি। খ্রীষ্টান আর বৈষ্ণবদের খানিক এই মত। এটা তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে বোঝা গেল। কিন্তু এর সাথে তো ব্রহ্মজ্ঞান যায় না। তাই বলা হল যে প্রতিটা জীবই আসলে শিব, বাকিটা মিথ্যা মায়া। মানে এই শরীরবোধ আরকি। তবে? শরীরটাই যদি মায়া হয়, তবে ধর্ষণটা কি করে সত্য হতে পারে? অপযুক্তি মানছি। কিন্তু এ যুক্তির সম্ভাবনা তো উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
ঠিক এইরকম ব্রহ্মজ্ঞানেরই কথা বলে যেত আসারাম। কেঁদে ভাসাতো ঈশ্বরের নামে। নিজে অনেকবার দেখেছি। কথামৃতে আছে, ‘যার ঈশ্বরের নাম করতেই চোখে জল আসে সে ঈশ্বরলাভ করেছে।‘ এবার কি বলবেন? আরো আছে, ঈশ্বরকোটি আর জীবকোটি। অর্থাৎ ঈশ্বরের নিজের ব্র্যান্ডের আর সাধারণ ব্র্যাণ্ডের। রামকৃষ্ণ নিজেকে ঈশ্বরকোটি বলে বিশ্বাস করতেন। একবার একজন তাকে কর্মফলের তত্ত্ব শোনাতে চাওয়ায় রামকৃষ্ণ বিরক্ত হয়ে মাষ্টার মশায়কে বলেন, ‘ওকে বোঝাও যে ঈশ্বরকোটির অপরাধ হয় না।‘ আরেকটা গোলমেলে তত্ত্ব। 'বায়ুতে সুগন্ধ দুর্গন্ধ দুই থাকে, কিন্তু বায়ু নির্লিপ্ত থাকে।' এটাও ব্রহ্মজ্ঞানের তত্ত্ব। তবে আর দৈবদৃষ্টিতে ভুল কোথায়? ধর্ষণের পাপই বা তাকে স্পর্শ করবে কেন?
আসারাম রামকৃষ্ণ নয়। কিন্তু কথায় কথায় রামকৃষ্ণ তথা নানা মহাপুরুষদের বাণী টেনে আনত। রামকৃষ্ণ প্রসঙ্গ বেশিই আসত। নিজেকে আসারাম ব্রহ্মজ্ঞানীই মানত। প্রায় যেন রামকৃষ্ণ সমকক্ষ। কিন্তু রামকৃষ্ণের কপট-ব্রহ্মজ্ঞান সংক্রান্ত গল্পগুলো বোধহয় এড়িয়ে যেত অথবা ভাবত যে ওগুলোর উর্ধে সে। হতেই তো পারে। কারণ বাকি ব্রহ্মজ্ঞানীর ক্রাইটেরিয়াগুলো তো মিলে যাচ্ছে।
আমি কয়েকদিন আগে বিদ্যাসাগরকে নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম। বিদ্যাসাগর আমাদের বেদান্ত দর্শনকে পাগলের প্রলাপের মত কিছু একটা ঠাওরাতেন। আসলে শুদ্ধতা খুব কঠিন একটা মাপকাঠি। আবার খুব সরলও। আমি এটা বলতে চাইছি না যে বেদান্ত বা কথামৃত বা ওই ধরণের অতীন্দ্রিয় দর্শন ধর্ষক তৈরি করে। কিন্তু এটা বলছি, তৈরি করার ক্ষমতা রাখে। আমি কালকূটের ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ থেকে শুরু করে নানা ধর্মকেন্দ্রিক স্থানে যে অনাচারগুলোর সাক্ষী হয়েছিলেন তার কথা স্মরণে রাখতে বলি। আর রইল অবশেষে নারীর কথা। সে প্রাচীন ভারতই হোক আর আধুনিক ভারতের গুরু অবতারেরাই হোক – খুব একটা ভালো কথা তো বলতে শুনিনি কাউকেই প্রায়। নারী একটা এক্সপেরিমেন্টের বস্তু ধর্মজগতে। সে কখনও দেবী, কখনও কামিনী, কখনও নিজের সংযমের পরীক্ষাপাত্র, তার নগ্ন কোলে বসে নিজের পুরুষাঙ্গের আত্মনিয়ন্ত্রণের শৌর্য্য পরীক্ষা করে নিতে হয়।
ব্যাপারটা একটু সামারাইজ করে নেওয়া যাক। আসারাম, একে ব্রহ্মজ্ঞানী, দুই ঈশ্বরের নামে চোখে জল আসে, মহাপ্রভুর মত নেচেকুঁদে একশা হয়, তায় অত মানুষের আলোকবর্তিকা, তায় কয়েকটা অবলা নারীর সাথে যৌন সম্পর্ক, থুড়ি লীলা রে বোকা ওটা লীলা। মহাপুরুষদের সব চেষ্টাই লীলা। আমি পড়িচি, ভুলভাল বোঝালেই হবে? তোমাদের ও জাগতিক শাস্তি, জাগতিক আইনব্যবস্থা ওপারে কি হবে? তখন আসারাম দেখে নেবে, কত ধানে কত চাল। নারী, তায় আবার শিশু, কিশোরী। অমন একটা ব্রহ্মজ্ঞানীর পুরুষাঙ্গের স্পর্শ পেয়েছিস, কোথায় ধন্য হবি, তা না কোর্ট কাছারি করতে লেগেছে। ধন্যি কলি বটে।
এরকম ধরণের ব্রক্ষ্মজ্ঞানের কথা শুনলে রামকৃষ্ণ বলতেন, অমন ব্রহ্মজ্ঞানে মুতে দিই।
“নিজের কষ্টের বেলায় সংসারী সাজো, অন্যের বেলায় ব্রহ্মজ্ঞানী সেজো না” – সত্যানুসরণ।