Skip to main content

১) “বাহ্যেন্দ্রিয় ও অন্তরিন্দ্রিয়ের সংযম, কায়িক, বাচিক ও মানসিক তপস্যা; অন্তর্বহিঃ শৌচ, ক্ষমা, সরলতা, শাস্ত্রজ্ঞান ও তত্ত্বানুভূতি এবং শাস্ত্রে ও ভগবানে বিশ্বাস – এই সকল ব্রাহ্মণের স্বভাবজাত ধর্ম” - গীতা

২) ক -“লোকবৃদ্ধির জন্য স্রষ্টা মুখ, বাহু, ঊরু ও পদ থেকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র সৃষ্টি করলেন” – মনু
খ – “ব্রাহ্মণদের জন্য, অধ্যাপনা, অধ্যয়ন, যজন, যাজন, দান ও প্রতিগ্রহ” – মনু
গ – “ব্রাহ্মণ এই সমগ্র সৃষ্টির প্রভু”- মনু। ঘ – “মানুষের মধ্যে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ” – মনু। 
ঙ – “ব্রাহ্মণদের দেহই সনাতন মূর্তি। তিনি ধর্মের জন্য জাত এবং মোক্ষলাভের যোগ্যপাত্র” মনু। চ –“পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সেই সব ব্রাহ্মণের সম্পত্তি। শ্রেষ্ঠত্ব ও আভিজাত্য হেতু ব্রাহ্মণ এই সবই পাওয়ার যোগ্য”...”অন্য লোকেরা যা ভোগ করে, তা ব্রাহ্মণের দয়া হেতু করে” ইত্যাদি ইত্যাদি.........আর এগোলাম না। শেষ করা দায় হবে। 
৩) “যার ভক্তি নেই সে ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণ নয়” – রামকৃষ্ণ। কিন্তু মনে রাখতে হবে সেই রামকৃষ্ণ মিশনেই ব্রাহ্মণ শরীরের কুমারী না হলে পূজ্য নয় অষ্টমীতে।


        অর্থাৎ এই হল বেদান্তের ব্রাহ্মণ আর ব্রাহ্মণতন্ত্রের ব্রাহ্মণের পার্থক্য। প্রথমটা হল এক ধরণের মানুষের কথা, দ্বিতীয়টা হল একটা হায়ারার্কি প্রতিষ্ঠার ভিত স্থাপন। প্রখ্যাত অধ্যাপক অশীন দাশগুপ্ত তাঁর প্রবন্ধ ‘সহিষ্ণুতার ইতিহাস’ প্রবন্ধে বলছেন অল বিরুনীর কিতাব-উল-হিন্দ এ ব্রাহ্মণদের সম্বন্ধে উল্লেখ করছেন, এগারো শতকের ব্রাহ্মণেরা অহংকারী এবং বিশ্বজগৎ সম্পর্কে অজ্ঞ ও অন্ধ। এই নিয়ে অবশ্য পরে অনেক জল ঘোলা হয়। কিন্তু কথাটা যে পুরো মিথ্যা নয় ক্রমশ একটা সমাজের অধঃপতনে সে কথা স্পষ্ট। 
        আজ এই কথাগুলো কেন? আমার আশ্চর্য লাগল, টুইটারের কর্তার ‘ব্রাহ্মণ পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থা নিপাত যাক’, কথাতে আপত্তি আজও ওঠে তবে জেনে। মধ্যযুগীয় সমাজব্যবস্থা, রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কারের পথে নানা প্রতিবন্ধকতার গল্প এতদিন শুনে এসেছি। আজ প্রত্যক্ষ করছি, একটা জাতের বুদ্ধিজীবী মহল তথা সাধারণ মানুষের বৃহৎ অংশ কি অসামান্য গভীর ঘুমে থাকা এতদিন ধরে অভ্যাস করে নিয়েছে। “যাই হোক, ওতে আমার কিছু এসে যায় না, যতক্ষণ না সরাসরি আমার ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য-সুরক্ষায় তা শঙ্কা আনে।“ রোগের লক্ষণ নিয়ে যত আলোচনা দেখি, তার কারণ নিয়ে গভীরে ভাবার সময় কোথায়? আর ভাববই বা কেন? আমার তো জনপ্রিয় হতে হবে, ভাবার দায় নিয়ে মাথা গরম করে, না ঘুমিয়ে ভেবে, বিপি বাড়িয়ে, বনের মোষ তাড়িয়ে আমার কাজ কি? তাই আমাদের সোশ্যাল নেটওয়ার্ক যে সোশ্যাইটির ছবি আনে, তা দেখলে হতাশই হই। যা হোক, এ তো পড়েইছি আমরা, নতুন কিছু আশাই বা করার কি আছে? 
        কিন্তু তবু। এই নিকৃষ্ট একটা তন্ত্রের বিরোধের জন্য একজন মানুষকে ক্ষমা চাইতে হল, কেন? না তিনি একটা অত্যন্ত অপ্রিয় সত্য অকপটে বলে ফেলেছিলেন, এবং আশা রেখেছিলেন যে ভারতীয়রা, প্রথম বিশ্বে পদার্পণে ইচ্ছুক ভারতীয়েরা তার কথার সমর্থন করবে, আর বাকিরা যারা মধ্যযুগীয়, তারা হেরে যাবে, লজ্জায় মুখ লুকাবে। কিন্তু তা হল না। বক্তার জন্য মুখ লুকাবার কাপড়ের ব্যবস্থা করল ভারতের প্রগতিশীল সমাজই। কেন চাইতে হল? না, কোনো যুক্তি নেই। সেন্টিমেন্ট আছে। আমাদের যেখানে যুক্তি থাকে না, সেখানে আমাদের সেন্টিমেন্টটা সাংঘাতিক। একটু এদিক ওদিক হলেই আমাদের সেন্টিমেণ্টে লেগে একাকার কাণ্ড হয়ে যায়। ভারতীয় সেন্টিমেন্ট।
        আজ ইণ্ডিয়ান এক্সপ্রেসে ইলাইয়া লিখছেন, পুরুষের শুক্রাণু পবিত্র আর মহিলার রজ কেন অপবিত্র? এ প্রশ্ন তিনি কাকে করছেন? যুক্তিকে না ভারতীয় সেন্টিমেণ্টকে? দক্ষিণের অনেক মন্দিরের আগে একটা কি দুটো হাতি বাঁধা থাকে, হয় সেগুলো জ্যান্ত না হয় মূর্তি। তার কিছু ধর্মীয় ব্যাখ্যা অবশ্যই আছে। কিন্তু আমার মনে হয় ভারতীয় সমাজকে ধাক্কা দিতে গেলে আগে ওই হাতির মত সেন্টিমেণ্টের পাহাড়টাকে ডিঙিয়ে সেই কাজটা করতে হবে। আর যদি যুক্তি আসে যে উনি বিদেশী হয়ে কেন নাক গলিয়েছেন? আমি মনে করিয়ে দিতে চাই, আমাদের রামমোহন, বিদ্যাসাগরও এই বিদেশীদের সাহায্য না পেলে কতটা নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছাতেন তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। 
        আসলে আমাদের এখানে পেরিয়ার আর আম্বদেকর ছাড়া এই বর্ণাশ্রম থেকে চিরকালের মত বেরোবার রাস্তা নিয়ে কেউ কথা বলেনি। কেউই না। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, তবে তা ঘনিষ্ঠ মহলেই। গান্ধী অস্পৃশ্যতা নিয়ে ভেবেছেন, কিন্তু এই প্রথার বিরুদ্ধে বলেননি। সর্বধর্ম সমন্বয়কারী রামকৃষ্ণও এক জায়গায় বলে বসছেন যে, শান্ডিল্য আর ভরদ্বাজ গোত্রের ব্রাহ্মণের হাজার দোষ থাকলেও পূজ্য। এরকম নানা ঘাঁটা কথা আমাদের মহাপুরুষেরা এত করে বলেছেন যে বলার নয়। স্বামীজিও এর খুব একটা বিপরীতে ছিলেন না, যদিও তার মধ্যে লক্ষ স্ববিরোধ। বাকি আর যারা অন্তত বাঙলার গুরুগণ কেউই এর বিপক্ষে ছিলেন বলে আমি পড়িনি। তাই বেদান্তের ‘সব সমান’ দর্শন আর মনুর বর্ণাশ্রম একসাথেই চলেছে। আমাদের দর্শনের এই কপটাচারকে আমরা ‘জটিল উদারতা’, ‘পরমার্থিক আর লৌকিক ব্যবহারের পার্থক্য’ ইত্যাদি নানা নাম দিয়ে এড়িয়ে গেছি। কিন্তু জীবাণুর যতই গালভরা নাম দিই না কেন, আদতে সে তো ক্ষতিকর জীবাণুই, তাই তাকে তথাকথিত সৎ কাজে, গোষ্ঠীস্বার্থের উদ্দেশ্যে যেভাবে লাগানো হয়েছে, তাকে একটা স্থায়ী আসন জনমানসে দেওয়া হয়েছে, সর্বপোরি তার যে একটা মোহ তৈরি হয়েছে, অভ্যাসের দাসত্ব তৈরি হয়েছে, তাকে উৎখাত করতে জানি না কতদিন আরো লাগবে।