সৌরভ ভট্টাচার্য
12 July 2019
প্রমাণপত্র নিয়েছেন? টিটি দেখবে... এয়ারপোর্টে ঢোকার আগে দেখবে... পুলিশ দেখবে... হোটেলে চেক-ইন-এ চাইবে। আরো কত কত জায়গায় দেখবে। আপনার আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড ইত্যাদি সাথে রাখুন। বয়েস হলে প্রতিবছর ব্যাঙ্কে জানিয়ে আসুন আপনি জীবিত – প্রমাণ দিন। আপনারা ভালোবেসে বিয়ে করুন, কি পরিবারের চাপে, কি যে কারণেই হোক – প্রমাণ কই? মরেছেনই যে তারই বা প্রমাণ কই? না না, অমুকে দেখেছে, তমুকে শ্রাদ্ধে খেয়ে গেছে বললেও হবে না, প্রমাণ কই?
এ সব তো হল সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রমাণ। গায়ে লাগে না। স্মৃতিতে লাগে। সব মনে রেখে রেখে গুছিয়ে রাখতে হয়। এরপর আপনি যদি মামলা-মোকদ্দমা ইত্যাদি করেন, সেখানে আরো প্রমাণ।
আপনি যোগ্য স্ত্রী তার প্রমাণ কি? আপনি যোগ্য প্রেমিক তার প্রমাণ কি? আপনি যোগ্য বন্ধু তার কি প্রমাণ? ব্যস, এইবার? কোত্থেকে কাগজে সই করিয়ে এনে চোখের সামনে মেলে ধরে বলবেন, ‘এই দেখো, প্রশাসনিক ভবন থেকে আমায় কাগজ দিয়েছে – আমি স্বামী / স্ত্রী / পুত্র / কন্যা / পুত্রবধূ হিসাবে এক্কেবারে যোগ্য, অর্থাৎ উত্তীর্ণ।’ না, সে পথ নেই। সে পরীক্ষার প্রশ্নাবলী আম্বেদকর কেন, কেউ ঠিক করে যায়নি। দেখলে না, অমন বউটারে রাজ্যবাসীর চূড়ান্ত দাবিতে আবার বার্নিং স্কোয়াডে নিয়ে যাওয়ার কথা হয়েছিল। সে তিনি পটাং করে মাটির নীচে সেঁইধে গেলেন আলাদা কথা, কিন্তু প্রমাণের কথা উঠেছিল তো? কেমন রাজনীতি একটা পরিবারনীতির মধ্যে ঢুকে পড়ল দেখলেন? কখন যে রাজনীতি পরিবারনীতিতে ঢোকে, আবার পরিবারনীতি রাজনীতিতে ঢোকে বলা ভারি শক্ত।
এখন কথা হচ্ছে, প্রশ্নাবলী কে ঠিক করবে? আপনার পরীক্ষক। সংরক্ষণশীল পরিবার, না আধা-সংরক্ষণশীল, না সম্পূর্ণ উন্মুক্তমনা? তারা ঠিক করবেন। কখনও সব ঢেকে, কখনও প্রায় সব খুলে আপনাকে প্রমাণ করতে হবে আপনি বংশের উপযুক্ত কঞ্চি। অর্থাৎ, আপনাকে নানাভাবে প্রমাণ করতে হবে আপনি যোগ্য। যেমন কখনও জিন্সের জায়গায় খদ্দর পরে, এক পোচের জায়গায় চার পোচ সিঁদুর লাগিয়ে, বাড়ি থেকে টাকা এনে, আধপেটা খেয়ে, না খেয়ে, পরে খেয়ে, পা টিপে, ঝাঁট দিয়ে, কাপড় কেচে, চোব্যচোষ্যে গেলার ব্যবস্থা করে, পুত্র জন্ম দিয়ে ঠিক সময় মত ইত্যাদি ইত্যাদি। এর উপরে আপনার যোগ্যতা নির্বাচন হবে। যদি এক্কেবারে ফেল করেন তবে ঝুলে যেতে পারেন কিম্বা মাটির নীচে সেঁধোবার সুযোগ না পেয়ে অগ্নিদগ্ধ হবেন। পরেরদিন কাগজে ছবি বেরোবে। উঁহু, সবাই আপনার ব্যথায় সমব্যথী হবে না। অনেক শাশুড়ি বউমাকে ছবি দেখিয়ে সাবধান করবেন, অনেকে বুঝিয়ে দেবেন, “তাও তো আমরা এ সব করি না।” অনেক বউমা নিজে থেকেই সাবধান হয়ে যাবেন। তবে এ তো সাধারণ স্থূল গল্প। এর চাইতে সূক্ষ্ম প্রমাণ তাগাদা জগৎ কি নেই? আছে।
তুমি আগের মত কথা বলো না... আগের মত তোমার শরীর সাড়া দেয় না... আগের মত তাকাও না... আগের মত রঙের জামাকাপড় পরো না... অর্থাৎ কিনা এসব করে প্রমাণ দাও, “তুমি তো সেই আগের মতই আছো”। তুমি ফেসবুকে, হোয়াটস অ্যাপে, রাস্তাঘাটে, শপিংমলে, সিনেমা হলে, বসার ঘরে, শোয়ার খাটে প্রমাণ দাও – তুমি একনিষ্ঠ, নইলে আমার সন্দিগ্ধ ভালোবাসা বাঁচবে কি করে?
তুমি সময় মত ফোন ধরে, সঠিক সুরে উত্তর দিয়ে, সঠিক সময় দেখা করে, সঠিক বস্ত্রে, সঠিক পোজে দাঁড়িয়ে থেকে প্রমাণ দাও – তুমি ভালোবাসো। আরো আছে, সোশ্যাল নেটওয়ার্কে আমার বা আমার গুষ্ঠির ছবিতে, লেখাতে, ইভেন্টেসে লাইক দাও, কমেন্টস দাও, প্রমাণ করো। অন্যের কীর্তিকলাপে না, আমার কীর্তিকলাপের দিকে হাঁ করে চেয়ে বসে থাকো রাতদিন। না, একদিনও ব্যতিক্রম হবে না। যদি ব্যতিক্রম হয়, তোমার মেলে, মেসেজবক্সে, হোয়াটস অ্যাপে – অভিমান, কোমল থ্রেট, ব্ল্যাকমেল – কি হল আমায় এড়িয়ে যাচ্ছ? নতুন পেলে? আমায় মন ভরছে না? প্রমাণ দাও... প্রমাণ দাও... প্রমাণ দাও।
ঘুম থেকে উঠে গুড মর্নিং থেকে শুরু করে রাতে গুড নাইট অবধি প্রমাণ করে যাও তুমি সম্পর্কে অন আছো, তোমার অ্যাভেলিভিলিটি লাইটটা যেন সবুজ থাকে হরদম জীবনে, তুমি প্রমাণ দাও, দিয়েই চলো; না, থেমো না, থামলেই আক্রান্ত হবে। ক্রমে তুমিও সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠবে। কিরকম? তখন তুমি ভাববে, আচ্ছা অনেকক্ষণ হল প্রমাণ চাইছে না তো? তবে কি অন্য কাউকে... তবে কি আমাতে সাফোকেটেড... ইত্যাদি ইত্যাদি, অর্থাৎ সাবধান, তোমাকেও ধরেছে সে রোগে।
কিন্তু কিসের এত প্রমাণ চাওয়া? কিসের এত সন্দেহ? কেন এত নিরাপত্তাহীনতা? বাইরে ব্যক্তিত্বের প্রবল প্রতাপ, কিন্তু নৈতিক দুর্বলতায় অন্তঃস্থল ক্ষয়িষ্ণু রোগে জর্জরিত।
এই তো হল তত্ত্বকথা, নীতির কথা। ব্যক্তিত্ব আর চরিত্রের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। প্রথমটার ভান চলে, দ্বিতীয়টার নয়। প্রথমটার বাঁধ বাইরে থেকে, দ্বিতীয়টার ভিত নিজের ভিতর। শক্ত হলে দাঁড়ানো যায়, নইলে বারবার নুইয়ে পড়ে। চারদিকে এত বাঁধ দেওয়ার তোড়জোড় যে ভিত গড়ার আর খেয়াল নেই কারোর। শক্ত বাঁধে ঠোকাঠুকি, কিন্তু নিজের ভিতে দাঁড়িয়ে শক্তহাতে নিজেকে সামলানো হাতের বড় অভাব। প্রমাণ দিয়ে দিয়ে, প্রমাণ চেয়ে চেয়ে ক্লান্ত শরীরে ঘুম। ঘুম না, ঘুম না, ওটা অবসন্নতা। প্যাকেটে করে ঘুম বিকোচ্ছে ওষুধালয়ে।
আচ্ছা প্রমাণ যদি নাই মেলে? যদি দূরত্ব বাড়ে অযুত নিযুত, ভালোবাসা কি মরেই তবে? ভালোবাসা কি নৈকট্যে বাঁচে না হৃদয়ে বাঁচে? ভালোবাসা কি ঘেঁষাঘেঁষি না চটকাচটকি না ফোনাফুনি না গল্পাগল্পি? এগুলো সব ভালোবাসা হলেও... বাকি কি তবে কিছুই নেই? বোঝাবুঝি? বিশ্বাস রেখে নিশ্চিত জীবন? সে কি নেই, সে কি নেই? নাকি সেও গেল নির্বাসনে? হায় রে হায়, ভালোবাসা তবে শুধুই শরীরী... হরমোন বোঝা চাপের তরী... সম্পর্ক তবে আদালতে বাঁচা মন উকিলের জারিজুরি।