Skip to main content

        ছোটোবেলায় আমি সান্টার গল্প শুনেছি। কিন্তু সে গল্প বলেই শুনেছি। যেমন প্রাণভোমরা রাক্ষসীর বুকে থাকে তেমন। যেমন লালকমল, নীলকমলের জন্য কোনোদিন অপেক্ষায় থাকিনি, তেমনই সান্টার জন্য কোনোদিন অপেক্ষায় থাকিনি। আজ অনেক বাচ্চাকে দেখি তারা রাতের ঘুমে, নির্দিষ্ট দিনে সান্টার উপহারের অপেক্ষা করে। বাড়ির লোক কিছু একটা কিনে মাথার কাছে রেখে দেয়। সে বাচ্চারা ভাবে সেটা সান্টার উপহার। 
        এর মধ্যে কতটা ভাণ, কতটা নির্দোষ সরলতা, কতটা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির মোহপরায়ণ আনুগত্য - বলতে পারি না। শুধু জানি এরকম কিছু আমার ছোটোবেলায় দেখিনি। হতে পারে আমি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়িনি বলে বা মায়ের অত্যন্ত বাস্তবমুখী স্বপ্নমেদ বর্জিত শাসন প্রণালীর জন্য, বা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সাথে, কেবল টিভি, ইন্টারনেট ইত্যাদির অনুপস্থিতির দরুণ নিবিড়ভাবে পরিচিত হতে না পারার জন্য। কারণ কিছু একটা হবে। 
        ক্রমে বড় হওয়ার সাথে সাথে সান্টার মত নানা দেবদেবীর গল্প জানলাম। লক্ষ্মী অর্থ দেন, সরস্বতী বিদ্যা দেন, মা কালী বিপদ থেকে বাঁচান, বিশ্বকর্মা যন্ত্রপাতিতে কুশলতা দেন, ইত্যাদি। এখন জানি সারা পৃথিবী জুড়ে সান্টারা আছে। সান্টার সাথে জুড়ে সেন্টিমেন্ট। সেই সেন্টিমেন্টে আঘাত করতে নেই, এই কথাটা সত্য অনুভবের চাইতেও অনেক বড় কথা। তাই সত্য যাক সেন্টিমেন্ট থাক। সান্টার সাথে সান্টার বিরোধ। কখনও সুপ্ত আগ্নেয়গিরি, কখনও উত্তপ্ত লাভা উদগারি। ধর্ম, সান্টাদের গল্প মানেই সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। সেই আগ্নেয়গিরির গায়ে গোলাপের চাষ হতেই পারে, জনবসতিও শান্তিপূর্ণ ভাবে থাকতেই পারে, কিন্তু তবু তা সুপ্ত আগ্নেয়গিরিতুল্যই৷ জাগলে টের পাওয়া যায়। 
        সান্টার গল্প যারা বিশ্বাস করে না, সান্টার গল্প যারা বলতে পারে না, তারা জনপ্রিয় হয় না। গণশত্রু হয়। সেন্টিমেন্টের ক্ষেতে মাজরা পোকা তারা। বিদ্বেষের আগুনে পুড়ে মরতে হয় তাদের। আমার যেমন মেলা বন্ধু বিচ্ছেদ হল ফেসবুকে এসে। এমন সব হাবজিগাবজি অবতার, ভগবান, মঠ মিশন নিয়ে লিখলুম বলে তারা চটে পালালো। যারা মিষ্টি মিষ্টি গল্প লেখে তাদের ওখানে আসর জমালো। দুঃখ পেলুম। চলে গেল বলে ততটা নয়। এত দুর্বল ছিল জানতে পেরে।
        দুর্বল বড় হিংসুটে ভক্ত হয়। তাদের জোরটা প্রেমের জোরে না হয়ে দলের জোরে হয়। তাই যেহেতু সত্যের ভিত নাই, সেন্টিমেন্টের কম্বলে হাত দিলেই কামড়াতে আসে। আঁচড়ে দেয়। দিয়েছেও অনেকে। সে যাক। তবু স্বভাব যায় কি মলে? 
        তবে সান্টা কি একেবারেই নেই আমার জীবনে? এসেছে তো। সে বড়দিনের মধ্য রাত্রে নয়। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছি। হাফ প্যান্টের বয়েস তখন। হঠাৎ কালো করে আকাশ ছেয়ে মেঘ। গাছগুলোর তলায় আরো নিবিড় ছাওয়া। ঘাসের উপর মেঘ ঢাকা চাদরে নিবিড় আদর। হাওয়া দিচ্ছে ভিজে বাতাস। দুপুরবেলা, অথচ চারদিকে কেমন শ্রাবণের মেঘে অল্প আলো, মায়াবী আলো। চারদিকের সব সবুজ মিলে কি আনন্দে অধীর হয়ে উঠেছে, মেঘ এসেছে বলে। 
        ঝড় শুরু হল। সাথে বড় বড় ফোঁটা বৃষ্টি। সারা প্রকৃতিজুড়ে কি সমারোহ, ঘরেতে মায়ের অপেক্ষা আমার জন্য। দৌড় দৌড় দৌড়। পিঠের মধ্যে অঙ্ক, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, ইংরাজি, বাংলা - সবাই লাফাচ্ছে। খাতা ভিজছে, পেন ভিজছে, টিফিনের টাকা ভিজছে। ওদের ভিজলে প্রাণ যায়। আমার যায় না। আমার আশেপাশে লক্ষহাতে আমায় ধরে ছুটছে জোব্বা পরা সেই মানুষটা, সেদিন থেকে আজও, আমার রবীন্দ্রনাথ, আমার সান্টা। মায়ের অপেক্ষা আমার জন্য রান্নাঘরে না, অনেক দূরে। ছুটছি তো ছুটছিই। দল নেই। শিষ্য নেই। গুরু নেই। বিদ্যা নেই। পাণ্ডিত্য নেই। উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। আছে গুটিকয়েক বন্ধু আর বিস্ময়ের উপর বিস্ময়, ব্যস!