Skip to main content
 
 
মানুষ যা যা কিছুকে অত্যন্ত করে চায়, তার প্রধানতম হল সমাজ। সে নিজেকে দেখতে চায় সমাজের আয়নাতেই। সমাজ তার অস্তিত্ব। তার পায়ের তলার মাটি। ব্যক্তি আর সমাজের মধ্যে যে দ্বন্দ্বটা আমরা দেখি, সেটার মূলে আসলে গঠিত, জীবিত সমাজ বনাম আমার কল্পিত, ধী-দৃষ্ট সমাজ। ব্যক্তি বলে যা আমরা বুঝি, তা একটা মৌলিক অস্তিত্ব তো কিছুতেই নয়। না হলে অভিব্যক্তি কথাটা অর্থহীন হত। দীর্ঘকালের ধারাবাহিক এক প্রক্রিয়ার ক্ষণিক বুদবুদ এই ব্যক্তিসত্তা। এমনকি জীবনবিজ্ঞানের কথা অনুযায়ী গর্ভস্থ একটা ভ্রূণকেও তার প্রাচীন গতিপথের ধাপগুলিকে একবার করে স্মরণ করতে করতে আসতে হয় ব্যক্তিজনি জাতিজনিকে স্মরণ করে বিজ্ঞানী হেকেল মহাশয়ের অসামান্য পর্যবেক্ষণ। তাই 'সমাজ' শব্দটা শুধু ভৌগলিক অথবা কোনো নির্দিষ্ট কালের গণ্ডীতে আবদ্ধ একটা কথা না। যা স্থবির তা প্রথা, বিশ্বাস, আচার ইত্যাদি হতে পারে। সেগুলো বদলে বদলে যায়, কিন্তু সমাজবোধটা না। কখনওই সমাজের বাইরে মানুষ যেতে পারে না। যায় যদি সে নিজের একটা সমাজ গড়ে নিতে চায়। যার উদাহরণে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী গঠিত হয়; তারা রাজনৈতিক কি ধার্মিক কোনো বিশ্বাসের তাগিদে স্বতন্ত্র হওয়ার চেষ্টা করে, আর বৃহৎ সমাজকে প্রভাবিত ও অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করে নিজের মধ্যে।
 
 
        আমাদের সামনে ইদানীং দুটো ঘটনা ঘটে গেল। করনি সেনা বনাম পদ্মাবতী, আর সমকামী বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের নতুন অবস্থান। দ্বিতীয় ঘটনাটার ইতিহাস বহু প্রাচীন। বিজ্ঞানের নতুন নতুন গবেষণা, আবিষ্কার সেই জনগোষ্ঠীর আন্দোলনের পথ সুগম করে দিলেও সারা বিশ্বে মূলখণ্ডের সামাজিক মানসিকতার প্রেক্ষিতে তার লড়াইয়ের পথ দীর্ঘ।
        এবার আসি প্রথম ঘটনাটায়। পদ্মাবতী আদৌ ছিলেন কিনা, নাকি তিনি কবি কল্পনা সে অন্বেষণের ভার নেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে যে কথাটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তা হল, রাজপুতের ভাবজগতের সমাজের সাথে বনশালী মহাশয়ের ভাবজগতের সমাজের একটা বিরাট বিরোধ এসে উপস্থিত হয়েছে। সমাজটা বাইরে থাকলেও সমাজের মূলটা থাকে মানুষের অন্তরের ভাবমুখের কেন্দ্রে। তাই ভিতরের বিরোধ বাইরে এসে পড়বে এ বুঝতে খুব কঠিন হয় না। রাজপুত কখনওই সমকামী বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ক্ষিপ্ত হবে না। কারণ সেটা তার সামাজিকবোধের সীমারেখার বাইরে, কিন্তু পদ্মাবতী তাদের। তাই বনশালী যেন তাদের সেই সামাজিক পরিসীমার মধ্যে ঢুকে নিজের রাজত্ব বিস্তার করতে চাইছেন, আর তাতেই রাজপুতেরা নিজেদের রাজ্যের স্থিতিশীলতা নিয়ে চরম সংকটে পড়ে যাচ্ছেন। ফল হিংসাত্মক। যে কোনো ভয়ের বাহ্যিক আকার হিংসাই হয়ে থাকে। একটা সুস্থ কুকুরও কখনও সাধ করে কাউকে কামড়াতে যায় না, যদি না কোনো কারণে তার থেকে কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা আশঙ্কা করে কিম্বা বিপন্ন বোধ করে। মানুষের সাথে পশুর পার্থক্যটা হল মানুষের একটা সামাজিক দেহ আর সামাজিক ভূমি আছে। কিছু উন্নত পশু সমাজেরও আছে যদিও তবে ততটা সুক্ষ্ম অভিব্যক্তি সে পথে হয়ে উঠতে পারেনি।
        একটা সমাজের বহুরূপ হতে পারে। নানা মান্যতাও হতে পারে। কিন্তু বৈপরীত্যের সহাবস্থান ততক্ষণই হতে পারে যতক্ষণ কেউ কারোর থেকে বিপন্ন বোধ না করেন। এ এক চিরকালীন সংগ্রাম। বাড়ির বয়স্কা মানুষটার সাথে নব্যযুগের নাতনির সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীর বিরোধ, বাবা-ছেলের বিরোধ, ধর্মে-ধর্মে বিরোধ, রাজনৈতিক মতাদর্শে বিরোধ ইত্যাদি সবই দুটো সামাজিক ধারণার বিরোধ। শুভ-অশুভে বিরোধের মূল কথাটাতেও একই সুর। তবে ঈশ্বরের কৃপা কিম্বা প্রকৃতির খেলা যাই বলি, যা অশুভ, যা স্থিতি আর বিকাশের বিরোধী তার মাত্রাটা চিরকাল কম। একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। জীবের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোর নির্ধারকের (জিন) একটা প্রকটগুণ হয়, আরেকটা প্রচ্ছন্ন। প্রচ্ছন্ন যে সে প্রকটের উপস্থিতিতে অপ্রকাশিত থাকে। বেশিরভাগ বংশগত রোগের জন্য দায়ী এই নির্ধারকগুলি প্রচ্ছন্নগোষ্ঠীভুক্ত। তা যদি না হত তবে সুস্থ থাকাটাই ব্যতিক্রম হয়ে দাঁড়াত।
        সমাজের ধারাকে শুধু যে আমরা বহন করে চলি তাই তো নয়, তাকে আমরা পরবর্তী প্রজন্মতে স্থানান্তরিত করতেও চাই। খুব আগ্রহের সাথে চাই। দেখা যায় অল্প বয়সে একটা মানুষ যতটা বিদ্রোহী, অবাধ্য, একগুঁয়ে থাকে, বয়েস বাড়ার সাথে সাথে সে নম্র, বাধ্য, আজ্ঞাবহ হয়ে উঠতে চায়। তার কারণটাও খুব জটিল কিছু না। অল্প বয়সে সে তার নিজের সামাজিক ভাবালোকে অন্যের হস্তক্ষেপ পছন্দ করে না। ক্রমে যত সে বড় হতে থাকে তার সেই পৃথক, স্বতন্ত্র সামাজিক ভাবধারার সাথে প্রবাহিত মূলস্রোতের ভাবধারার লড়াইয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে আপোষ করতে শুরু করে। আপোষ ক্রমে অভ্যাস হতে শুরু করে। যে যতটা আপোষ করে সে পরবর্তী নব প্রজন্মের প্রতি ততটা রূঢ় হয়। সে জানে কতটা মূল্য তাকে চোকাতে হয়েছে তার স্বতন্ত্র সামাজিক স্বপ্নকে লালন করার জন্য।
        এরই মধ্যে কেউ কেউ আসেন যারা নিজেদের ভাবের সমাজের মাধ্যমে অন্যের ভাব সমাজকে প্রভাবিত করতে পারেন। বিরোধ সেখানেও হয়। কিন্তু সংঘর্ষ অমঙ্গলের পথে না হেঁটে ক্রমে মঙ্গলের পথে ফেরে। সেই বিখ্যাত লাইন ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে’ – এর একটা উদাহরণ হতে পারে। যে কোনো প্রতিভাবান ব্যক্তিই এর উদাহরণ যারা মঙ্গলের মধ্যে পথ খোঁজেন। আমাদের দেশে এককালে ধর্ম আর দর্শনের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য ছিল না। সেখানে অনেক আলোচনায় দেখেছি মানুষের মঙ্গল কিসে, এই আলোচনার সূত্রে আধ্যাত্মিক আলোচনা শুরু হয়েছে, কোনো বিশেষ মত প্রচারের জন্য নয়।
        সমাজের গভীর কেন্দ্রে এই মঙ্গলবোধটা লোপ পেলে সমাজ আর টেকে না। এই মঙ্গল কিসে? এই মঙ্গল তার চিত্তের বিকাশে তার অহং -এর স্বার্থ চরিতার্থতায় নয়। এই কথাটা ইতিহাসে বারবার ভোলার প্রমাণ আছে। বহু বিরোধ আগেও হয়েছে ভবিষ্যতেও হবে; আর এরই মধ্যে অতি ধীর পদক্ষেপে বিকাশের সম্বেগে, প্রেমে অভীদীপ্ত হয়ে মানুষের আত্মা মঙ্গলের সমাজে সার্থক হবে।