Skip to main content

আমাদের ছোটোবেলায় Turning Point বলে একটা অনুষ্ঠান দূরদর্শনে হত। Yash Paul সৌম্যকান্তি চেহারা, খুব কাছের একজন দরদী শিক্ষকের মতন বিজ্ঞানের নানা অজানা বিষয়ে আলোপাত করতেন।
        চব্বিশে জুলাই মারা গেলেন। বিশেষ কেউ জানতে পারল না। কারণ, ১) তিনি কোন ধর্মগুরু নন, ২) তিনি রাজনৈতিক কোনো ব্যক্তিত্ব নন এবং ৩) অবশ্যই বিনোদন জগতের জনপ্রিয় কেউ নন।
        বিজ্ঞান পড়ার প্রতি যত আগ্রহ, বিজ্ঞানচর্চার প্রতি সে আগ্রহ কি স্বাধীনতার এত বছর পরেও জেগেছে আমাদের জনমানস স্তরে? বিজ্ঞান নিয়ে পড়লে ডাক্তার-ইঞ্জিনীয়ার হওয়া যায়, তাছাড়া পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে মাথা উঁচু করে হাঁটা যায় - এই এত অবধিই বিজ্ঞানের চর্চা। তবে জনমানসে নেই কেন? কারণ সব আমাদের 'ব্যাদে আসে' (বেদে আছে)।
        বিজ্ঞানের প্রতি অনীহার মোড় আজ অথবা কাল হলেও ফিরতে পারে, ভয়ংকর হল ছদ্ম-বিজ্ঞানের আড়ালে আসল বিজ্ঞানের ধামাচাপা পড়ে যাওয়াটা। রবীন্দ্রনাথের একটা লাইন বারবার বলেছি, অত্যন্ত প্রিয় লাইন আমার - "আমার আঁধার ভালো, আলো কে যে লোপ করে খায় সেই কুয়াশা সর্বনেশে"।
        আমাদের সেই স্বাধীনতাটার দিকে এগোবার চাই। স্কুল কলেজের বিজ্ঞানের সিলেবাসের কথা বলছি না। বলছি দৈনন্দিন জীবনে তাকে মান্যতা দেওয়ার কথা। বলা হয়, Cleanliness is next to Godliness. সে পরিচ্ছন্নতা কি কেবল বাইরের? কক্ষনো না। সে পরিচ্ছন্নতা চিন্তার জগতে না এলে বিপদ। বিজ্ঞান ভবিষ্যতবাণী সে অর্থে করতে পারে না, মৃত্যুকে ঠেকাতে পারে না, অমরত্বের প্রতিশ্রুতি দিতে পারে না - কিন্তু ভয়মুক্ত করতে পারে তার যুক্তিতে, তথ্যে, স্বচ্ছতায়।
        কিন্তু ইদানীং বেশ কিছু সাহিত্য রচনা হচ্ছে বিজ্ঞান আর ধর্মকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে তার মধ্যে একটা মিল খুঁজে। একে সিউডোসায়েন্স বলা যেতে পারে। এটা ভয়ানক। এতে দুর্বল মন কিছু প্রশস্তি পেতে পারে, সুস্থ সবল মন না। মানুষকে কতরকম ভয় যে ধর্ম দেখাতে পারে, এবং আজও দেখিয়ে চলেছে নানা ধর্মগুরুরা, প্রাণ শঙ্কিত হয় দেখলে-পড়লে-শুনলে।
        আরেকদিক, টিভি চালান, দেখুন জ্যোতিষীর পর জ্যোতিষী। আপনার ভবিষ্যতের জ্যান্ত ছবি তেনাদের নখদর্পণে। ভয় আর লোভ - এই দুটোর মত পুঁজি সংসারে খুব কম। মারো খোঁচা, চালাও ব্যবসা। ধর্ম-ব্যবসা, ভাগ্য-ব্যবসা তখনই কমতে পারে যখন এই সার্বজনীন বিজ্ঞানমনস্কতা বাড়বে।
        তবে ঈশ্বরের কি হবে? বিজ্ঞানমনস্কতা মানে নাস্তিকতা নয়। তিনি যদি সত্যিই সত্যস্বরূপ হবেন, তবে কি তিনি চাইবেন আমরা সারাটা জীবন মায়ের আঁচল ধরে ধরে ভীরু হয়ে ঘুরি? কখনই না। চিত্তে সংশয় যদি জাগে তবে সে সত্যকে জানার জন্য, মিথ্যাকে দূর করার জন্য। কখন ওই মিথ্যার পায়ে আত্মসমর্পণের জন্য নয়। সত্য কোনো খেলনা নয় যে একজন আমায় হাতে ধরে বলল, খেলো, চারদিক ভুলে মেতে যাও খেলায়, আর আমি অমনি মেতে গেলুম। কিন্তু তাই হচ্ছে। সত্যান্বেষণ সর্বদাই নাস্তিকতার ছদ্মবেশে আসে। তাতে হাত-পা পোড়ে। পুড়ুক। কিন্তু ফাঁকি থাকে না। দুর্বলতা থাকে না। দুর্বলতাকে শ্রদ্ধা-বিশ্বাসের, অতিভক্তির আড়ালে রেখে বেশিদিন চলা খুব শক্ত। বেকন একবার বলেছিলেন, দুই আর দুই যোগ হলে পাঁচ হয় বললে আমি রাগব না, হাসব। বড়জোর করুণা হবে। কিন্তু বিশ্বাসের বিরুদ্ধে বললে? তেলেবেগুনে চটে লাল।
        মির‍্যাকেল মানে কি ধর্ম? না। সে নিজেও যদি সত্যান্বেষণ না হয়ে চর্বিতচর্বণ হয়ে ওঠে, তবে বিপদ। মৃত্যুর সামনে, বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে বুক কাঁপে নি, কোনো ঐশীশক্তির সাহায্যের কাছে করুণ প্রার্থনা করেনি এমন মানুষ হাতে গোনা হয়ত। কিন্তু সে তো চরম বিকল অবস্থা মনের, সেই কি তার স্বাভাবিক অবস্থা? শরীরের রোগগ্রস্থ অবস্থাকে স্বাভাবিক অবস্থা মেনে নিলে তো বিপদ। মনের মধ্যে গভীরতম কেন্দ্রকে জাগিয়ে তোলে যে শক্তি, ক্ষুদ্র স্বার্থের থেকে বেরিয়ে কায়-মনে-বাক্যে গতিময় করে তোলে যে মহৎস্বার্থ - সেই ধর্ম। তাই কোনো মন্দিরে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকাকে উত্তম ভক্ত ছোটো চোখে দেখে। সে বলে তাঁর ইচ্ছার কাছে মাথা নোয়াও। নিজের ক্ষুদ্র ইচ্ছাকে বৃহৎ ইচ্ছার মধ্যে লীন করে দাও। এই উত্তম ভক্তি। সেখানে ভয় নেই। প্রেম আছে। সহিষ্ণুতা আছে।
        আজ এই স্বাধীনতাই কাম্য। চিত্ত মুক্ত হোক নির্ভীক সত্য ধর্মে আর মনন-মেধা মুক্ত হোক সৎ বিজ্ঞানে।