Skip to main content


‘সংস্কৃতি’ শব্দের ইংরাজী পরিভাষা – culture. ঠিক কি কারণে জানি না, ‘জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস’ আর ‘চলন্তিকা’ দুটো অভিধানেই ‘সংস্কৃতি’ শব্দটার ব্যাখ্যা দেওয়ার পরপরই ‘culture’ শব্দটা লেখা আছে, যেন ওই শব্দটা না হলে আমরা ঠিক বুঝতে পারতাম না, কি বলতে চাওয়া হচ্ছে। তবে কি সংস্কৃতি শব্দটা খুব পুরোনো নয় বাংলা ভাষায়? অথবা ধারণাটা? সে তত্ত্ব ভাষাবিদদের দরবারে রেখে আপাতত আমি আমার আলোচ্য বিষয়ে আসি। তার আগে ছোটো ঘটনা বলে নিই। 
কদিন আগে সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরছি এক বন্ধুর বাইকে, হঠাৎ কানে আসল ভীষণ সুন্দর সুরে কোথাও রামচরিতমানস গাইছেন কেউ। এগোলাম সেদিকে শব্দভেদী বাণের মত। পৌঁছিয়ে দেখি বিরাট একটা মাঠে বিশাল প্যাণ্ডেল, হাজার হাজার লোক, বাইরে বাইক, সাইকেল, টোটো থিকথিক করছে। মঞ্চে একজন রামচরিতমানস গাইছেন, ব্যাখ্যা করছেন। নীচে গুণমুগ্ধ শ্রোতাগণ। বলা-বাহুল্য নিরানব্বই ভাগ তাদের অবাঙালী। এর খানিক আগেই ছাব্বিশে জানুয়ারী উপলক্ষে নানান জায়গায় মোচ্ছবের আয়োজন দেখতে দেখতে ফিরছিলাম। তুলসীদাসজীর রামচরিতমানস নিয়ে আর কি বলার। সে তো নিজেই ভারতবর্ষের একটা অধ্যায়। এটা সংস্কৃতি। আমাদের সাধনলব্ধ, যুগসঞ্চিত সম্পদ। আর ওই মোচ্ছবটা বিনোদন।


Culture – the arts and other manifestations of human intellectual achievement regarded collectively. (Oxford dictionary) 
সংস্কৃতি – অনুশীলন-বদ্ধ দেহ-মন-হৃদয় ও আত্মার উৎকর্ষ (সাহিত্য সংসদ)


ছোটোবেলায় একটা শব্দ খুব শুনতাম, ইদানীং কম শুনছি বা শুনছিই না বলা যায় – অপসংস্কৃতি। আদৌ এরকম একটা শব্দ হয় কি না অভিধানে জানি না। হওয়াটা খুব একটা বাঞ্ছনীয়ও নয়। কারণ সংস্কৃতি বলতে যা বোঝায় অভিধান অনুযায়ী, তার বিপরীতার্থ হওয়া খুব একটা যুক্তিসঙ্গত নয়, অন্তত আমার মতে। 
সে যা হোক, শব্দটার ইঙ্গিত বুঝতে অসুবিধা হয় না। তবে আজ শব্দটার প্রয়োগে এত অনীহা কেন? কারণ অনেকটা যেন মাছের বাজারে আঁশটে গন্ধের অভিযোগ জানানোর তুল্য ঘটনা সেটা আজ। আমার চারপাশে সে অর্থে সংস্কৃতি চর্চার অবকাশ কি খুব পর্যাপ্ত? সংস্কৃতির নামে প্রাণহীন পুনরাবৃত্তির অভাব হয় তো সে অর্থে নেই, কিন্তু সে পথে সজীবতার অভাব একান্ত সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে বলে আমার মনে হয়। কারণ সেই জায়গাটা নিচ্ছে ক্রমশঃ বিনোদন, ইংরাজীতে enterntainment. এ সবের মধ্যেও কাজ হচ্ছে না বলছি না, তবে বিপদটা হচ্ছে, বিনোদন আর সংস্কৃতির মধ্যে কোনো ফারাক নেই, এমন একটা মানসিকতা কোথাও যেন তৈরি হচ্ছে। যেন সংস্কৃতির ছদ্মবেশে আসুক বিনোদন। 
সংস্কৃতির সাথে একটা শব্দ খুব অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে – চর্চা তথা অনুশীলন। অনেকে সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে এক করে একটা মিউজিয়ামস্থিত মানসিকতায় সংস্কৃতিকে দেখতে চান, তাদের কথা বলছি না। সেখানে চর্চা শব্দটা খুব গুরুত্বপূর্ণ না, সেখানে পুনরাবৃত্তি তথা একটা অচলায়তনের ধারণা চলে আসে। তা না, সময়ের, সমাজের যেমন একটা ধারা আছে, তেমন বুদ্ধিবৃত্তিরও একটা নিজস্ব ধারা আছে, প্রবাহ আছে, অববাহিকা আছে। সেই অববাহিকার পলি জমে তৈরি হয় সংস্কৃতি। তাতে কিছু কাঁকড় জমে, তা কালের স্রোতে ধুয়েও যায়। এর প্রধান চালিকাশক্তি হল বোধ। বোধের উন্মেষ, মার্জনা যেখানে নেই, সেখানে সেই শূন্যতা স্থুল বিনোদন দ্বারা পরিপূর্ণ থাকবে, এতে আশ্চর্য হওয়ারও কিছু নেই অবশ্য। আবার এ স্থুল বিনোদন বস্তুটা কি?
যদি বিনোদনকে খুব কাছ থেকে দেখি, তবে তার মধ্যে দুটো দিক আছে - এক আনন্দ, দুই আমোদ। আনন্দ, বোধের আলোয় জন্মায়। আমোদ জন্মায় ইন্দ্রিয়ের অথবা স্থূল মনের বৃহৎ আন্দোলনে। সেই অর্থে কিছু বিনোদন সুক্ষ্ম, কিছু স্থূল হতে পারে। কিন্তু কথা হচ্ছে, এর পরিমাপ করবে কে? সংসারের সিংহভাগ রমণী যদি সারাটা সন্ধ্যে অসামান্য চিত্রনাট্য সম্বলিত ধারাবাহিক দেখতে থাকেন আর পুং কুল নানান চাপে চাপান্বিত হয়ে মুক্তির পথ খোঁজেন, তবে সেখানে বিনোদনই হবে সুয়োরানী। এর জন্যে গভীর তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের আবশ্যকতা নেই। সংস্কৃতির চর্চা যে করব সে সময় কোথা বাপু?
কথাটা মিথ্যা নয় পুরোপুরি। জীবন যাত্রার দ্রুতময়তা বেড়েছে। বুদ্ধি আর বোধের সাথে লাগাম আর ঘোড়ার একটা সম্পর্ক আছে। বোধ যেখানে ঘুমন্ত বা আগ্রাসী উচ্চকাঙ্ক্ষায় মোহমুগ্ধ সেখানে গতির সাথে ছন্দ আশা করা দুরূহ ব্যাপার।
সেই বুদ্ধির চর্চা আবার বিজ্ঞানের দ্বারে এমন নাড়া বেঁধেছে, আর সুখের এমন সব কায়দাকানুন রপ্ত করেছে, তাকে বোধের মন্দিরে ফেরানো সত্যিই আজ দায়। অর্থাৎ বিজ্ঞানকেও এখন তত্ত্ব ছেড়ে প্রয়োগোন্মুখ হতে হচ্ছে। হতেই হবে। জ্ঞানের দায় ততক্ষণই মানবো যতক্ষণ দিনান্তে সে আমার পাতে রাজভোগ আনতে পারে, নতুবা তাকে পেন্নাম করে শিকেতে তুলে রাখো। এ হল আরেক বিনোদন। উচ্চাঙ্গের বিনোদন। বিজ্ঞান মানে এখন ডোরেমন। সেখানে তবু খানিক বোধের দায় দেখানো হয়। কিন্তু বিজ্ঞানের ঝোঁক বিনোদনের দিকে এমন ধারার যে তাকে অস্বীকার করার কথা ভাবা অর্থে সন্ন্যাস নেওয়ায় সামিল। অগত্যা মঙ্গলশঙ্খ ধুলায় পড়ে থাকে। কে দেবে ফুঁ? অকারণে ঘুম কে ভাঙাবে? গাল খেতে হবে যে? ওর চাইতে রবি ঠাকুরের বৌদির সাথে সম্পক্ক, গান্ধী কোন নারীর কোন স্তনেতে হাত রাখতেন, বিবেকানন্দর কি কি রোগ ছিল ইত্যাদি মহান সব চর্চায় মাতি। স্থূল হলে দু’হাতে জাপটিয়ে যে সুখ, সুক্ষ্ম হল সে সুখ কোথায়? ফসকে যায় যে?


তবে উপায় কি নেই? আছে। যাঁরা এরই মধ্যে খানিক সংস্কৃতি চর্চায় মগ্ন তাদের ছোটোবেলার দিকে তাকাই। দেখি বীজ রোপিত হয়েছে সেইকালেই, সেই নরম মাটিতে। ব্যতিক্রম যে নেই তা বলছি নে। তবে সে চর্চার বীজ সেই বয়সে অভ্যেস না হলে বেলা গড়ালে সব দিকে তাল রেখে চলা সত্যিই খুব ঝঞ্ঝাটের। তখন একপক্ষ আরেকপক্ষকে বলেন আঁতেল, আরেকপক্ষ অন্যপক্ষকে বলেন ইতর। লেগে যা লেগে যা নারদ নারদ। অনেক কথা হল। এবার উপসংহার টানি, utopian ঢঙে। লোকে যা বলে বলুক। স্বপ্ন না দেখব তো এতগুলো স্নায়ুকোষ মাথায় পুষছি কি কত্তে? ধ্রুপদী ভাবে বলি - 
মাঝামাঝি অবস্থানটার জন্য বিদ্যালয়গুলোর ভাবনা-চিন্তা বদলানোর আশু প্রয়োজন। ভালো সাহিত্য, সঙ্গীত, চলচিত্র, শিল্প ইত্যাদিকে মান্যতা দেওয়া, তার সমঝদার করে গড়ে তোলার দায়িত্ব যদি অল্প বয়েস থেকে দেওয়া যায়, তবে পরীক্ষা পাসের থেকেও বড় একটা লক্ষ্য পাওয়া যায়। প্রয়োজনের অতিরিক্ত যে কাজ মানুষ করে সে নিতান্ত প্রাণের টানে করে, আনন্দ থেকে করে। যে আনন্দ আরেক আনন্দের উৎস খুলে দেয় সে সৃষ্টির আনন্দ। উৎপাদন আর সৃষ্টির মূল প্রভেদটাই সেইখানে। একটার পরিণামে আনন্দ, আর আরেকটার সূচনা থেকেই আনন্দ। সেই আনন্দ থেকে জন্মায় শুদ্ধ জ্ঞান। যাতে সে নিজেকে নিজের মধ্যে আবিষ্কার করে। বেঁচে থাকার একটা কারণ পায়। দুর্ভাগ্য আমরা যে অসামান্য সম্পদ থেকে আমাদের ছাত্রছাত্রীদের বঞ্চিত করে রেখেছি বহুকাল। সেই কর্ষণের দিন এসে গেছে। তবে আবার মঙ্গলশঙ্খ আর আর মঙ্গলঘটের খোঁজ হবে। আর খুঁজতে বেরোবে আমাদেরই পরবর্তী প্রজন্ম আগের প্রজন্মের হাত ধরে।