Skip to main content

নেতাজী অন্তর্ধান রহস্যের পর দেশ হয় তো এই প্রথম এতবড় রহস্যের সন্ধান পেল, সুশান্তের মৃত্যু রহস্য। যে রহস্যের সন্ধান কোর্টে, প্রিন্ট-ইলেকট্রনিক মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় হয়েই চলেছে, হয়েই চলেছে। সে হোক, প্রতিদিন চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরোক, লকডাউনে বাঁচার একটা রসদ পাওয়া যাক, সব ঠিক আছে। কিন্তু বর্তমানে আরেকটি যে পালক যুক্ত হল, সাদা পালক না অবশ্যই, কালো পালক, রিয়া চক্রবর্তী। কে দোষী, কে নির্দোষ সে বিচার না হয় কোর্ট করুক, কিন্তু বাকিটা? যার মোদ্দা কথায় ‘আসুন রিয়ার ব্যক্তিগত গোপনীয় জীবনের দিকে উঁকি দিই’ ধরণের ইঙ্গিতপূর্ণ হেডলাইন? অসহ্য।

       আসলে একজন মহিলার ব্যক্তিগত জীবন পুরুষের সম্পত্তি। তার অধিকারের মধ্যেই পড়ে। সেই ব্যাসদেবের গপ্পোটা ভাবুন, দুর্যোধনের কি ইচ্ছা হল? দ্রৌপদীকে তার ব্যক্তিগত কক্ষ থেকে তুলে নিয়ে এসে তাকে ভরা সভায় উলঙ্গ করে সে দেখবে। ভীষণ একটা যেন স্বাভাবিক ইচ্ছা। শ্যাওলার মত কিছু অবান্তর সামাজিক রীতিরেওয়াজে পুরুষের এইসব ইচ্ছাগুলোকে ফেন্সিং করা থাকে। সেই ফেন্সিং ডিঙিয়ে যেতে পারাটা পৌরুষ না আইনভঙ্গ? পাঠকমাত্রেই এর উত্তর জানেন। তাই সাইনি আহুজার কেরিয়ারটা মাঠে মারা গেল নিয়ে দীর্ঘশ্বাসযুক্ত পোস্ট, পেজ থ্রি কভারেজ দেখি।

       দুটো শব্দ – ব্যক্তিগত আর গোপনীয়, পারসোনাল আর প্রাইভেসি। একটা কথা কি জানেন, প্রাইভেসির কোনো বাংলা ঠিকঠাক হয় না। আমরা প্রাইভেসির বাংলা করেছি গোপনীয়তা। তবে সিক্রেসির বাংলা কি হবে? অর্থাৎ প্রাইভেসি বলে কোনো শব্দের প্রয়োজন যেন আমরা অনুভব করিনি। ওই যে আছে না, “তুমি জন্ম হইতেই বলিপ্রদত্ত”, এর অর্থ আমরা এইরকম করে নিয়েছি, তুমি সমাজের জন্য জন্মেছ, তোমার জীবনের সমস্ত খুঁটিনাটি সমাজ ঠিক করে দেবে, তোমার নিজের বিবেক-বিচার-শখ-আহ্লাদ-ইচ্ছা-বাসনা সব ঠিক করে দেবে সমাজ। তুমি তো সব কিছুর নিমিত্তমাত্র। তোমার নিজের অস্তিত্ব কোথায়? তুমি তো এই মহাকালের সমুদ্রে একটা বুদবুদ মাত্র। প্রাইভেসি বলে কোন শব্দ আমরা তাই আমাদের অভিধানে ঠাঁই দিইনি। হুম, ‘অন্দরমহল’, ‘অন্তঃপুর’ বলে কিছু কিছু শব্দ বানিয়ে দিয়েছি, যে শব্দের সুরটা গোপনীয়তার ইঙ্গিতে বাজে। সেই গোপনীয়তা রক্ষা করাকে জেনো আমার মার্জিত পৌরুষ আর সেই গোপনীয়তা ভেঙে ঢুকে পড়া আমার অমার্জিত পৌরুষ। মোদ্দা কথাটা এই দাঁড়ালো যে তোমার গোপনীয়তা রক্ষা করার সব ভার আমার। তাই মাঝে মাঝে সমাজ যদি ভুল করে সেই গোপনীয়তা ভেঙে ঢুকে পড়ে তবে আশ্চর্য কিছু হোয়ো না, অমনটা মাঝে মাঝে হতেই পারে। তোমার পক্ষে দুর্ভাগ্যজনক হলেও, অস্বাভাবিক নয়।

 

       একজন মহিলার পার্সোনাল ব্যাগ ভীষণ একটা চাপা কৌতুহলের বিষয়। ফিসফিসানির বিষয়। আসলে কি আছে ওর মধ্যে? স্যানিটারি ন্যাপকিন তো থাকবেই, যখন তখন পিরিয়ড শুরু হয়ে যায় না!? আহা রে চুক... চুক... চুক...। কণ্ডোম? থাকতেই পারে, হাঁটাচলা চোখের যা চাওনি, ওসব থাকলে বিচিত্র কিছু নয়।... আরে না না ওনার ব্যাগে কণ্ডোম থাকতে পারে না, কি শুদ্ধ, কি পবিত্র দৃষ্টিটা না? যেন তাকালেই মা মা একটা ভাব, ওনার ব্যাগে তুলসীপাতা, মধু, কথামৃত, জপের মালা এইসবই থাকবে, তাই না রে? আর ওই মহিলার দেখ কালো ব্রা-টার স্ট্র্যাপটা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, লাল ব্লাউজের ফাঁক দিয়ে, কিভাবে ঘেমেছে দেখ, আরে বগলের পাশ থেকে দেখ, ক্লিভেজ ভিজে একাকার নিশ্চয়।...
       এই গোপনীয়তাকে ভেঙে ফেলার ইচ্ছা আসলে আমাদের অভিযানের লালসা। কারণ ওই যে বললাম, মহিলার ব্যক্তিগত জীবন হয় না, গোপনীয় জীবন হয়। আর সেই গোপনীয়তাটাও আমারই জন্য সুরক্ষিত করে সে রাখে, কবে আমি তার সেই গোপন দুনিয়ার একছত্র অধিপতি হব। সব মহিলাই এই চায়, এই জন্যেই তারা অপেক্ষা করে। কিন্তু তারা এমনি এমনি তার সেই গোপনীয়তা আমায় দিয়ে দেবে বুঝি? আমাকে তা লড়ে নিতে হবে, সে চায় তা, আমরা জানি। তাই তো জোর খাটালে সে কপট রাগ দেখায়, কিন্তু আসলে সে চায় আমি তার গোপনীয়তা ছিনিয়ে নিই। কারণ একজন মেয়ের পক্ষে সম্ভব একটা এতবড় ভার একা বহন করার? কক্ষনোও না। তার গোপনীয়তা তো তার নিজের নয়! তাই মাঝে মাঝে আমার জোরটা এত বেশি হয়ে যায়, বেহিসাবী হয়ে যায়, সমাজ তখন তাকে বলাৎকার, ধর্ষণ ইত্যাদি নামে ডেকে কি একটা পলিটিক্যাল কারেক্টনেস দেখায়। আসলে তো সবাই জানে, ব্যাপারটা আমি ঠিকই করেছিলাম, কারণ ওই যে, মহিলার ব্যক্তিগত বলে কিছু হয় না, সবটাই গোপনীয়, যা তার নিজের নয়, আমার ভোগের সামগ্রী, আমার পৌরুষের জোরেই একমাত্র যা সুরক্ষিত। আর হবে নাই বা কেন? তার বাড়িঘর পরিবার সব কিছু থেকে যখন আমি তাকে আমার পরিবারে আনছি, তার মানেই তো তাকে আমি ছিন্নমূল করে দিচ্ছি, তাই না? তবে তার আর ব্যক্তিগত কি থাকল? সবটাই তো আমার।

 

       এই হল আমাদের বিবেকের নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া অন্ধকার, অনালোকিত মানসিকতা। ‘টাইট্যানিক’ সিনেমার শুরুতে একটা কথা ছিল, আমার স্পষ্ট মনে নেই, তবে অল্প অল্প মনে আছে, বৃদ্ধা রোজ বলছে, ‘মহিলার হৃদয় সমুদ্রের মত গভীর রহস্যে ভরা।‘ কথাটা আমার সেই বয়সে শুনে খটকা লেগেছিল, আজ বিরক্ত লাগে। কেন পুরুষের হৃদয় কি মরুভূমির মত স্পষ্ট? সব কিছু দেখা যায়? একদম চারদিকে ধু ধু করছে শুধু বালি আর বালি?

       এইখানেই গোলমাল। রহস্য, গোপনীয়তা। এর সাথে অবশ্যম্ভাবী জুড়ে যে শব্দটা, তা হল অ্যাডভেঞ্চার। সংসারের সমস্ত রহস্য, গোপনীয়তা ভেদ করে জানাকে আমরা তো সেইভাবেই দেখি।

       যে কথাটা দিয়ে শুরু করেছিলাম, রিয়া দোষী না নির্দোষ, তা আইন-আদালত জানাক। আমরা আমাদের এই নোংরা, কলুষ, বিকারযুক্ত কৌতুহল থেকে যেন মুক্তি দিই নিজেদেরকে। যেন ব্যক্তিগত আর গোপনীয় – এই দুটো শব্দের মধ্যে দাঁড়িয়ে –প্রাইভেসি শব্দটার মানে শিখতে শুরু করি। আমাদের অভিধানে না থাক, আচরণে আসুক, ক্রমে অভিধানে এসে যাবে।