সৌরভ ভট্টাচার্য
7 February 2020
জীবনের উদ্দেশ্য কি?
টলস্টয় তাঁর 'কনফেশন'-এ বলতে চাইছেন বিশ্বাসের কথা, faith। আমাদের শব্দ 'শ্রদ্ধা' কথাটা কি কাছাকাছি? বিশ্বাস করতে হবে, ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে হবে। কোন ঈশ্বর? সেকি প্রতিষ্ঠিত ধর্মের? উত্তর হ্যাঁ-ও বটে, না-ও বটে। সেখানে ঠিক-ভুলে মেশানো একটা অবস্থা। বেছে নিতে হবে। জীবনচর্যায় সরলতা আনতে হবে। আরো মাটির কাছাকাছি আসতে হবে। ঈশ্বরের অন্বেষণ হতে হবে বৌদ্ধিক, কৌতুহল মেটানোর জন্য নয়, প্রাণের গভীরের আকুতিতে, অনুভবে। তার জন্য জীবনে একটা বড় প্রশ্ন জাগতে হবে, এ জীবনের উদ্দেশ্য কি?
টলস্টয়ের 'কনফেশন' পড়তে পড়তে আমার বারবার কথামৃতের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল, একই কথা, জীবনের উদ্দেশ্য কি? ঠাকুরের উত্তর - ঈশ্বরলাভ, চৈতন্যলাভ, বিবেক-বৈরাগ্যলাভ।
সে সময় কলকাতায় পাশ্চাত্য চিন্তাধারা, জড়বাদের জয়-জয়কার শুরু হব হব করছে। সাথে খ্রীষ্টধর্ম, ব্রাহ্মধর্মও প্রচার ও প্রসার লাভ করছে। সেদিন নানাভাবে মানুষ উত্তর খুঁজছে, এই একই প্রশ্নের উত্তর, তবে জীবনের উদ্দেশ্য কি? কিন্তু এই প্রশ্ন কতজন মানুষের জীবনে আসে? টলস্টয়ের বলা একটা প্রাচ্যের গল্পেই আসা যাক।
একজনকে একটা বাঘে তাড়া করেছে। সে দৌড়াতে দৌড়াতে একটা কুয়োর মধ্যে লাফ দিয়েছে। কুয়োর নীচে পড়ে যাওয়ার আগেই কুয়োর দেওয়ালে ঝোপঝাড় ধরে ঝুলে পড়েছে, কারণ কুয়োর নীচে কুমীর। উপরে বাঘ, নীচে কুমীর। চারদিকে অন্ধকার, শোনা যাচ্ছে কুট্ কুট্ করে কিসের যেন আওয়াজ হচ্ছে। কিসের আওয়াজ? ভালো করে খেয়াল করে দেখা যাচ্ছে যে ইঁদুরের দল ঝোপঝাড়গুলো দাঁত দিয়ে কাটছে। অর্থাৎ, তার নীচে পড়ে কুমীরের পেটে যেতে আর বেশিক্ষণ নেই। এমন সময় সে খেয়াল করল তার সামনের ঝোপঝাড়ের পাতায় কিছু মধু পড়ে। সে তৎক্ষণাৎ সেই মধু জিভ দিয়ে চাটতে শুরু করে দিল।
এই হল জীবন। এখন সংসারে সিংহভাগ মানুষ নানা নেশায় ছুটে চলেছে। কেউ অর্থ, কেউ মান-সম্মান, কেউ সুখ, কেউ অ্যাডভেঞ্চার --- আরো নানারকমভাবে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার উপায়ে। এর মধ্যে জীবনের কি উদ্দেশ্য এ হেন প্রশ্ন নিতান্তই বিলাসিতা অনেকের কাছে, অনেকের কাছে আপাতত কোনো একটা উত্তর আছেও হয় তো বা। কিন্তু এ সমস্ত কিছুর একটা অন্ত আছে, একটা বৈরাগ্য জাগার সময় আছে। সবার অবশ্যই নয়, কারোর কারোর। সে হঠাৎ করে এই সুখের মেলায় নানা উপকরণে সাজানো সব কিছু ছেড়ে কেঁদে ওঠে। যেন নাগরদোলায় ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ করে তার তারায় ভরা আকাশটার দিকে চোখ গেছে। সে বলে উঠেছে, কে আমি? কেন এ বিশ্বচরাচর? কেন আমি এসবের মাঝখানে? মৃত্যু কি? কেন এ সব কিছুকে এমনই রেখে আমায় চলে যেতে হবে? কোথায় যাব? মৃত্যুর পর কি অবশিষ্ট থাকে কিছু? আত্মা বলে কি কিছু হয়?
সে নাগরদোলা থেকে নেমে আসে। সব কিছু ছেড়ে একা হতে চায়। মানুষ দুঃখ থেকে দূরে থাকে, এর ব্যাখ্যা খুঁজে পায়, কিন্তু সে যখন সুখের থেকে মুখ ফিরিয়ে বলে, "আমার চাই না", তখন সংসারী ভাবে এর মাথাটা গেছে, সুখকে চায় না কে?
এরপর আসে বুদ্ধিজাত নানা জ্ঞানের অন্বেষণ। সব কিছুর ব্যাখ্যা আছে সেখানে। বিজ্ঞান তাকে নানা বিষয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সব তত্ত্বের আভাস দেয়, বিশ্লেষণের পর বিশ্লেষণ করে সে অণু-পরমাণু-DNA-RNA-গ্রহ-নক্ষত্র ইত্যাদি বিস্ময়ের পর বিস্ময়ের দরজা খুলে দেয়। নানা অসম্ভবকে সম্ভব করার কৌশল তার হাতে তুলে দেয়। সে সেদিনের নচিকেতার মত প্রশ্ন করে, কিন্তু এতো ব্যাখ্যা, এ তো শুধুই সুখের উপকরণ, এ কি অনন্ত? এ কি আমায় জীবনজিজ্ঞাসার উত্তর দিতে পারে? এ কি আমায় শান্তি দিতে পারে?
না পারে না, বিজ্ঞান ঘুম দিতে পারে, শান্তি দিতে পারে কই? সে বলে জীবনের উদ্দেশ্য বলে কিচ্ছু হয় না, সব অর্থহীন, শূন্য বিষাদময় অবশেষে।
টলস্টয় রামকৃষ্ণের কথা বলেননি, কিন্তু রামকৃষ্ণের পথে কিছুটা হেঁটে ফেলেছেন নিজের অজান্তেই যেন। বুদ্ধির অগম্য কী কোনো সত্য আছে এ সংসারে?
রামকৃষ্ণদেবের উত্তর, আছে।
সংশয়ী উত্তর দেবে, তবে কি সে বুজরুকি নয়?
রামকৃষ্ণদেবের উত্তর, তোমার অনুভবের, তোমার কান্নার উত্তর যে সত্য, সে কি যুক্তির সত্য, সে বুজরুকি? বাইরে থেকে আহরিত জ্ঞানের সত্য? তোমার স্ত্রী-পুত্র-পরিবারের প্রতি ভালোবাসা কি যুক্তির সত্য না অনুভবের সত্য? যাকে অনুভবে অনুভব করা যায়, যাকে বোধে বোধ করা যায়, তাকে যুক্তিতে ধরবে কি করে? একসের ঘটিতে কি চারসের দুধ ধরে? তাঁর জন্য কাঁদতে পারো?
রবীন্দ্রনাথ বলছেন, একটা ফুলের দুটো সত্য আছে। এক, সে জননাঙ্গ, বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, অর্থাৎ বাইরে থেকে যে জ্ঞানের আহরণ, আমাদের যুক্তি আর পর্যবেক্ষণের বিশ্লেষণে। দুই, সুন্দর, আমাদের হৃদয়ের দৃষ্টিতে। দুই সত্য।
যে ফুলকে শুধুই জননাঙ্গ দেখে সে খুব বড় মাপের যুক্তিবান হতে পারে, কিন্তু তার দেখা একদেশী, সে মানুষ হিসাবে অসম্পূর্ণ, কারণ তার হৃদয় সত্যশূন্য।
এ তো গেল তত্ত্বের নানা দিক নিয়ে আলোচনা। এর বাইরে কি কিছু নেই?
আছে, সরলতা। বুদ্ধির সরলতাকে বলি বোকামি, অনুভবের সারল্যকে বলে চরিত্র। বুদ্ধি তীক্ষ্ম হোক, ক্ষুরধার হোক, কিন্তু চিত্ত সবল হোক, সরল হোক। এমনই একটা চরিত্রের কথা বলতে গিয়ে রামকৃষ্ণদেব বলছেন - ভক্ত হবি তো বোকা হবি কেন?
ধর্মের সার চিত্তশুদ্ধি - বিবেকানন্দ সমস্ত ধর্মের সার আলোচনা করতে গিয়ে বলছেন। সব ধর্মেই গোল আছে, বালিতে চিনিতে মেশানো আছে - রামকৃষ্ণদেবের উক্তি।
টলস্টয় যখন এই বই লিখছেন তখন তার 'অ্যানা কারেনিনা', 'ওয়ার অ্যান্ড পিস' -এর মত কালজয়ী উপন্যাস লেখা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মনের মধ্যে তীব্র যন্ত্রণা, সংশয়। কি হল এতে? কি হবে এই নাম, এই সুখ, এই আড়ম্বরপূর্ণ জীবনে? কি হবে এতে?
আমার একটা গপ্পো মনে পড়ল। ব্যাসদেব ক্ষুণ্ণমনে বসে আছেন, ইতিমধ্যে তার 'মহাভারত' লেখা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মন ভীষণ বিষণ্ণ, কি যেন হল না, কি যেন হয়নি, কোথায় যেন একটা ভুল হয়েই যাচ্ছে। এমন সময় নারদ এসে তার পাশে বসলেন, ব্যাসদেবকে জিজ্ঞাসা করলেন কি কারণে এত বিমর্ষ তিনি? ব্যাসদেব সব বললেন। নারদ বললেন, "বুঝেছি, দেখুন আপনি মহাভারতে নানা কথা লিখলেও কৃষ্ণকথা বড় অল্প লিখেছেন। সসীমকে নিয়ে জীবের তৃপ্তি নেই। জীব অসীমকে অনুভব করে, অসীমের মধ্যে নিজের পরিণাম খোঁজে, আপনি সেই রসে জীবকে বঞ্চিত করেছেন, আপনি কৃষ্ণকথা লিখুন। কৃষ্ণই সেই অসীম। জীবকে সেই কথা শোনান, সে তৃপ্ত হবে, আপনিও তৃপ্ত হবেন।" এরপর ব্যাসদেব ভাগবত রচনা করেন, এমনই প্রচলিত কথা।
টলস্টয় শান্তি পেয়েছিলেন কিনা জানি না। কেউ কোনোদিন শান্তি পেয়েছে কিনা জানি না। মানুষ মৃত্যুকে যখন খুব স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারে, সংসারে সমস্ত ক্ষতিতে, অভাবে, দুর্ভাগ্যে যখন অবিচলিত থাকতে পারে তখন মানুষের কাছে দাঁড়িয়ে দেখেছি তার মধ্যে এক গভীর জীবনবোধ, যা বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে। যে বিশ্বাস শান্তির কথা বলে, মৈত্রীর কথা বলে, ধৈর্যের কথা বলে, ত্যাগের কথা বলে। এর বিপরীতকে সে অজ্ঞানতা বলে, মোহ বলে। এমন মানুষ দেখেছি। বড় বড় ডিগ্রী নেই, কিন্তু তার পাশে বসলে প্রাণ জুড়োয়। সে এই বিশ্বের সব কিছুর মধ্যে একজনের স্পর্শ পেয়েছে যেন অনুভবে, সে ব্যাখ্যা করতে জানে না, ভালোবাসতে জানে, সহ্য করতে জানে, শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে জানে - নিজের ভিতর ও বাইরেতে।
এর বাইরে যারা দল বেঁধে ধর্মচর্চা করে, জোর করে বোঝাতে চায়, প্রচারই যাদের মূল উদ্দেশ্য, যারা রাতদিন "আমরা-ওরা" যুদ্ধে ব্যস্ত, যারা সব কিছুকেই তাদের মন গড়া গল্পের ছাঁদে দেখতে চায়, যাদের অনুভব বলতে হিংসা আর স্বার্থপরতা, ক্ষমতা বলতে বাকচাতুরী আর আত্মপ্রতিষ্ঠা - এরা পরজীবী, এদের থেকে শত হস্ত দূরে থাকলেই মঙ্গল। এরা জানে সবশেষে এরাই সব কিছুতে ঠিক, বাকিরা সব কিছুতেই ভুল। এ সব ধর্মধ্বজীদের থেকে দূরে সরে সেই শান্ত, তৃপ্ত, সহজ সরল, বুদ্ধিদীপ্ত মানুষগুলোর মধ্যে জীবনের গভীর রহস্য অনেক বেশি প্রকট। আমাদের কপাল, আমরা সারাজীবন হয় অবতার, নয় মঠ মিশন, নয় ব্র্যান্ডেড সাধু সন্ন্যাসী, নয় অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন বাবাজীর কাছে ঘুরে বেড়াই জীবনের এই সার সত্যটাকে জানার জন্য, আসল সত্য চারিদিকে হাজার হাজার সাধারণ মানুষের শান্ত, সংযত, তৃপ্ত, সর্বংসহা জীবনশৈলীকে উপেক্ষা করে। যেখানেই সত্যকারের জীবন, সেখানেই সত্যকারের জ্ঞান, সত্য, শান্তি।