সৌরভ ভট্টাচার্য
10 April 2018
বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আলোকিত করেও আমার দোরগোড়ায় আলো করার মত আলো কম হয় না। প্রতিটা প্রাণী-উদ্ভিদ এই কথাটাকে তার প্রাপ্য হিসাবে এমন করে জানে যে সে নিয়ে তাদের সংশয় হয় না। একবার পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময় দেখেছিলাম, কি উতলা হয়ে, ভীত হয়ে, ডানা ঝাপটিয়ে, চীৎকার করে পাখিগুলো পাগলের মত করছিল। ওই যে আছে না, "না চাহিতে মোরে যা করেছ দান-- / আকাশ আলোক তনু মন প্রাণ", এ কথাটা ভুলে যাওয়াটাই সত্য অর্থে মূঢ় হয়ে বাঁচা। একটা হোটেলে গেলে, কি বিমানে উঠলে, কি ট্রেনে উঠলে - কত কি মনে রেখে চলতে হয়। এই কার্ড, সেই প্রমাণপত্র ইত্যাদি ইত্যাদি। তার যেন কোনো ভুল না হয় কত সতর্কতা রেখে চলতে হয়। সেরকম এতবড় একটা ঘটনার মধ্যে জন্মে গেলেও তার কিছু দায় থেকেই যায়। পেয়াদা নেই ঠিক, কিন্তু আত্মপ্রসাদ বলে একটা কথা আছে, তার মাধুর্য কমতে শুরু করে, ফিকে হয়ে যায়। সারাদিন ব্যাঙ্ক, অফিস, পাড়ার মিটিং, বিয়ের কেনাকাটা, স্কুলের মাইনে... লক্ষকোটি উপলক্ষ্য, আবার তার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশের প্যাঁচের দুর্ভাবনায় জড়িয়ে থাকতে থাকতে নিজেকে অবশেষে ইন্সিওরেন্স কোম্পানির ম্যাচুরিটি প্রত্যাশী, অমুক অফিসের চেয়ারকর্তা বই যে কিছু মনে হবে না। এর বাইরে বেরোতেই হবে। অকাজের শ্বাস নিতে হবে।
একটা নীরব নির্জনতা নিজের চারদিকে না গড়ে নিতে পারলে ভিতরে ভিতরে কোথাও একটা সুতো খসে যাবে। তার জন্যে কোত্থাও যাবার লাগে না। নিজের মধ্যে এক ছিলিম কৃতজ্ঞতা আর আধ-ডজন নির্জনতা হলেই হয়। আমাদের মা-ঠাকুমা'র প্রজন্মকে দেখেছি অনেক সকালে উঠে পড়তেন। সকাল আটটার মধ্যে কত কাজ তাদের সারা হয়ে যেত। তার মধ্যে কিছু অসাংসারিক কাজও তো থাকত। পূজোর ফুল তোলা, তুলসীমঞ্চে জল দেওয়া, উঠোনটা পরিষ্কার করা, কিম্বা কিছু না করেও বাগানে অথবা ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা। এ মানুষগুলোর উপরে তো কম চাপ থাকত না। আমরা এক একজন, এক এক সময়ে যে যার কর্মক্ষেত্রে যাব তার রুচি অনুযায়ী খাবার বানানো, টিফিনের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি ওই অল্প সময়ের মধ্যে কি নিপুণভাবে সব হয়ে যেত। কিন্তু এর মধ্যেও দেখেছি নিজের রুচি-ইচ্ছা অনুযায়ী দিনের এক খণ্ডে নিজের সাথে কি সুন্দর কাটাতেন। ওই সময়টায় আমিও কাছে যেতে অস্বস্তিবোধ করতাম। যেন আমার খুব কাছের জন হয়েও তারা সে সময়টায় অনেকটা দূরের। আজ বুঝি সেই নির্জনতাতেই তারা এমন আশ্রয় হয়ে ওঠার সাধনাটা করতেন। আমাদের সাধ্য ছিল না তাদের চরিত্রের দিকে আঙুল তুলে নিজের মনের অজান্তেও কোনো কটুশব্দ উচ্চারিত করতে। সেই ব্যক্তিত্ব, সেই মহত্বটার জন্য তারা কোনো হেঁটমুণ্ড তপস্যা করেননি। নিজেকে শুদ্ধ, পরিশীলিত আর স্বচ্ছ রাখার মত ভারসাম্য নিজের মধ্যে তৈরি করে নিতে পেরেছিলেন। যা তাদের দিত তাদের সেই আত্মগত ক্ষণগুলো।
আজ ছবিটা বড্ড এলোমেলো। তার একটা প্রধান কারণ আমাদের নির্জনতা আছে কিন্তু নীরবতা নেই। কিছুটা সময় নিজের মধ্যে সে নীরবতা গড়ে তোলার কথা বললাম সেটা মোবাইলের নেটদুনিয়া সংক্রামিত। আমরা একা হয়েও নিজের চারদিকে একটা অশ্রুত কোলাহলের মধ্যে। কই নির্জনতা? আমায় ঘিরে যে মহা মহিমাময়, বিচিত্র শোভার, রহস্যময়, প্রাণবন্ত প্রকৃতিটা সে যে চিরকাল নীরব। আমার নীরবতায় তার নীরব প্রতিচ্ছবি না পড়লে আমার সবটুকু কোলাহলে শেষ হয়ে যাবে। আমার ছাত্রছাত্রীদের মাঝেমাঝে বলি, দেখ তোরা এই মুহূর্তে আমার বাড়িতে, মানে হালিশহরের একটা বাড়ির ছাদের তলায় যেমন বসে আছিস, ঠিক তেমনই উত্তর চব্বিশ পরগণাতেও আছিস, পশ্চিমবঙ্গেও আছিস, ভারতেও আছিস, এশিয়াতেও আছিস, আবার বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যেও আছিস। তোর শরীরের একটা ভৌগলিক অবস্থান আছে। কিন্তু তোর মনের ভৌগলিক অবস্থানটাকে যদি না বাড়াতে পারিস তবে কোনোদিন পালে সমুদ্রের হাওয়া লাগবে না। ডিঙি চড়েই জীবন শেষ হবে। অথচ দেখ, একটু ভাবনাটাকে বড় করে নিলেই আমার এই বারান্দায় বসেই তুই ব্রহ্মাণ্ডের আশ্বাস পাচ্ছিস। খোলা চোখে দেখে মানুষ কিচ্ছু হয়নি কোনোদিন, মানুষ আসল যা দেখেছে তা চোখ বন্ধ করেই, জ্ঞানের আলোতে। নইলে আগাথা দিদির চোখে যা পড়ে আমার চোখে পড়ে না কেন? কিম্বা নিউটন বা মেণ্ডেল? আসলে তারা দেখার বাইরে কিছু একটা দেখার অভ্যাস করেছে যে।
তো যে নীরবতার কথা বলছিলাম, আমাদের সে নীরবতা নেট সংক্রামিত। অশ্রুত কোলাহল বেষ্টিত। যে মানুষের নীরবতা নেই, তার মানসিক সাম্যতাও নেই। নৈতিক জীবন তো দূরের কথা। নিজের মধ্যে এত কোলাহল যে নীতির সুক্ষ্ম স্বচ্ছতা চাপা পড়ে যায়। মেয়ে মায়ের চরিত্রের দিকে আঙুল তুলছে, কটাক্ষ করছে --- এ বড় দুর্ভাগ্যের। সে নিজেও একটা নৈতিক জীবনের কাঠিন্য থেকে মুক্তি চাইছে, “তুমিও তো করো”–র অজুহাতে। এ আশঙ্কার। এ কথা বলা বাহুল্য মায়ের ছাপ যতটা গভীরে গিয়ে প্রভাবিত করে বাবার ছাপ ততটা নয়। বাবার দুশ্চরিত্র হওয়াটা সন্তানের পক্ষে দুর্ভাগ্যপজনক। তার বেশি কিছু নয়, সে বেঁচে গেলেও যেতে পারে। কিন্তু মায়ের চরিত্রের কালিমাটা তার ভবিষ্যৎ জীবনের পক্ষে শুধু দুর্ভাগ্যজনক নয়, বিষবৎ। কোনো কিছুর উপর বিশ্বাস রাখা, শুদ্ধতায় আস্থা রাখা, নিজের জীবনের গতির হাল ঠিক রাখা ক্রমে দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে তার পক্ষে। এ কোনো সমাজবিজ্ঞানের পরিসংখ্যান মেপে বলছি না, এত বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। আমি দুটো ধরণের ঘটনারই বহুবার সাক্ষী হয়েছি। প্রথম ক্ষেত্রে সফল হয়েছি ছেলে বা মেয়েকে ঠিক রাস্তায় নিয়ে আসার চেষ্টায়। যাদের বাবার সমস্যা। পালিয়ে গেছে, বা অন্য কারোর সাথে থাকে, কিম্বা পাড়ার সবাই জানে তার বাবার সাথে আর কারোর কোনো অবৈধ সম্পর্ক আছে। কিন্তু দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কিছু করতে পারিনি। যাদের মাকে নিয়ে একই ধরণের সমস্যা, তাদের সন্তানদের মধ্যে একটা সন্দেহপ্রবণতার বিষ এমনভাবে ঢুকে থাকে যে পরক্ষণেই কি করবে সে নিজেও জানে না। যা নিজে বলছে তা নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না যেন। যা বলছে অত্যন্ত বিশ্বাসের সাথে কার্যক্ষেত্রে তার বিপরীত ঘটিয়ে বসছে। অথবা বাইরে অত্যন্ত নিপুণ কার্যক্ষম হলেও ভিতরে ভিতরে অত্যন্ত নিষ্ঠুর আত্মকেন্দ্রিক একটা জীবনশৈলিতে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে। বহুবার দেখলাম।
আমার কথার স্রোত অন্যদিকে ঘুরে গেছে, বুঝছি। তবু বলেই ফেললাম। যাই হোক, যেটা বলছিলাম, নীরবতার কথা। আমার মধ্যে নীরবতা তৈরি করতে পারলে বিশ্বের নীরব যে ছন্দ তার সাথে একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। একটা জিনিস খেয়াল করলে দেখা যায়, নিজের মধ্যে নীরব হতে পারলে, ভয়-আতঙ্ক-দুশ্চিন্তা ইত্যাদির মাত্রাও উল্লেখযোগ্য হারে কমতে শুরু করে। ভালো বই, ভালো গান, ভালো আলোচনা ইত্যাদি এই নীরবতা তৈরির প্রথম ধাপটা অবধি হয়ত নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু ওরা কেউ অন্দরমহল অবধি যেতে পারে না। সেখানে নিজেকে নিয়ে একাই যেতে হয়। জীবনের গভীরতম কবিতাটা, সংগীতটা শোনার সৌভাগ্য হয়। শূন্যের মধ্যে যে বিশ্রাম মেলে সে বিশ্রাম আমি কোনো পর্বত, সাগরে, জঙ্গলে পাইনি, নিজের মধ্যে সেই নীরব শূন্যতাটা যা দিতে পারে। ক্রমে সে আমাদের মধ্যে এমন একটা দরজা খুলে দেয় যে আমি নিজেকে পাই এ মহাসংসারের প্রাচীনতম নাড়ির টানে। একটা পাখির উড়ে যাওয়া, একটা পাতা খসে পড়া, এক টুকরো মেঘ ভেসে যাওয়া, একটা মানুষের নীরবে হেঁটে যাওয়া ইত্যাদির নতুন একটা ভাষার সাথে পরিচিতি মেলে। শান্তি আসে। যে শান্তি কোনো ওষুধে মেলে না। কোনো বাহ্যিক শুশ্রুষায় মেলে না। মেলে নীরবতার আত্ম-শুশ্রুষায়। তবে গিয়ে সেই পূর্বোল্লিখিত গানটার পরের দুটো লাইনে আমাদের প্রবেশ মেলে –
“দিনে দিনে তুমি নিতেছ আমায় সে মহাদানেরই যোগ্য ক’রে / অতি-ইচ্ছার সংকট হতে বাঁচায়ে মোরে।।”