পুরাণে আছে যেদিন শ্রীকৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেন কারাগারে দেবকীর সন্তান হয়ে, সেদিনই যশোদার গর্ভ থেকে জন্মান যোগমায়া। কৃষ্ণের কারাগারে আসেন যোগমায়া, শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে প্রতিস্থাপিত হতে। এবং কংস যখন তাঁকে দেবকীর আগের সন্তানদের মত হত্যা করতে যান তাঁকে মাটিতে আছাড় মেরে, ঠিক তখনই কংসের হাত থেকে সরে গিয়ে যোগমায়া দুর্গারূপ ধারণ করেন, এবং বলেন, তোমাকে যে বধ করবে, সেই শ্রীকৃষ্ণ ইতিমধ্যে জন্মগ্রহণ করেছেন। তুমি প্রস্তুত হও।
আজ মাইকে কোথাও বেজে উঠল, “আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর….”। এ শব্দ ক'টা শুনলেই এতদিন নিজের গোটা ছোটোবেলা যেন কেউ উপুড় করে সামনে মেলে ধরত। কান্না পেত। যে সুখ হারিয়ে গেছে সে সুখের জন্য।
আজ কান্না পেল অন্য কারণে, মনে পড়ল, যে অভয়া, যে তিলোত্তমা, সে প্রতি বছর দুর্গাপুজো করত নিজের বাড়িতে। পরম আনন্দের সঙ্গে করত। গোটা পাড়াকে ডেকে আনত বাড়িতে! কিন্তু এ বছর?
অশৌচ মানি না আমি। শোক মানি। তার চলে যাওয়া যদি স্বাভাবিক চলে যাওয়া হত, শোককে মেনে নিতাম। কিন্তু এ তো স্বাভাবিক চলে যাওয়া নয়! তবে অশৌচ কীসের?
বরং একটাও পুজো বন্ধ না হোক। যতগুলো পুজো হবে, সঙ্কল্প হোক তার নামে। যাকে কেউ বলছেন অভয়া, কেউ বলছেন তিলোত্তমা। আমি বলছি অপরাজিতা। যদি কেউ বলেন, তার নামে সঙ্কল্প হয় কী করে? শাস্ত্রের বিধান নেই যে!
তাকে বলবেন, শাস্ত্রের যে বিধানে তার নামে সঙ্কল্প হয় না, সে বিধানের কথা আপাতত থাক। শাস্ত্রের যে বিধানে অবিনশ্বর আত্মার কোনো আসা যাওয়া নেই, সেই বিধানে হোক তার সঙ্কল্প। তবে এ বছরের সব ক'টা দুর্গাপুজো হবে সার্থক।
অভয়া ক্লিনিক সে-ই কাজটাই করছে বলে আমার বিশ্বাস। কারণ চিকিৎসাকে সে তার ব্রত, তার একান্ত সেবা হিসাবে নিয়েছিল। অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সে তার কর্তব্য করেছে, এমনকি শেষদিন অবধি। অভয়া ক্লিনিক সে-ই কথাই বলছে। তার সে বিশ্বাসকেই মর্যাদা দিয়েছে। আমার বিশ্বাস, যে চিকিৎসকেরা তার সঙ্গী ছিলেন, তারা যেদিন আবার আগের মত কাজে ফিরবেন, তখনও তাদের মনে পড়বে অপরাজিতার নিষ্ঠার কথা। তাদের অনুপ্রেরণা জাগাবে আজীবন অপরাজিতা।
তাই ভাবছিলাম, এ বছরে মায়ের কোনো পুজো যেন বন্ধ না হয়। সব পুজোর সঙ্কল্প হোক তারই নামে। তবেই মা পুজো নেবেন, এ আমার স্থির বিশ্বাস। কিন্তু পুজো বন্ধ হলে, সে কষ্ট পাবে, যার কাছে পুজো ছিল কাজেরই মত প্রাণের শ্রদ্ধার। তার বিশ্বাস, তার শ্রদ্ধাকে শ্রদ্ধা জানানোর সময় এটা।
আজ অশৌচের সময় নয়। সঙ্কল্পের সময়। অপরাজিতা সঙ্কল্পের। গোটা বিশ্ব জানুক, বাংলার মেয়ের গায়ে হাত পড়লে বাঙালি কী কী করতে পারে।
বাংলা, বাংলার মেয়েকেই চায়, স-সম্মানে, সমর্যাদায়। বুকের মধ্যে - বোধনের মন্ত্রে, অষ্টমীর অঞ্জলিতে, দশমীর কান্নায়, বিজয়ার ভূমিষ্ঠ প্রণামে। সে হৃদয়ের মধ্যে আসন পাতে হিমালয়ার কন্যার জন্য। যে পর্বতের কন্যা পার্বতী, সে-ই বাংলার ঘরে এসে উমা, যাকে নিয়ে বাঙালি কবি আগমনী লেখেন। মা কৈলাস থেকে আসতে আসতে দেখেন, বাংলার ঘরে বাইরে আসন পাতা তাঁর জন্যে। তাঁর কৈলাসের সুখের থেকেও কোটিগুণে খাঁটিসুখ এই বাঙলা মায়ের সবুজ আঁচলে। যে আঁচল অপেক্ষা করে আছে, শুধু পুজোর জন্যে না, তাকে আগলে রাখার জন্যেও।
আজ পুজো বন্ধের দিন না। অশৌচের দিন না। আজ সঙ্কল্পের দিন। অপরাজিতা সঙ্কল্পের দিন। এই ভাবনা আমার।